যুক্তরাষ্ট্র, মার্কিন নৌবাহিনী, চীন, নৌশক্তি, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল, প্রতিরক্ষা বিভাগ

প্রধান বিপক্ষ শক্তিগুলোর মোকাবেলায় পিছিয়ে পড়ছে মার্কিন নৌবাহিনী

২০২২ সালে আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো এবং বৈদেশিক ও প্রতিরক্ষা নীতি বিভাগের পরিচালক কোরি শ্যাক ফরেন অ্যাফেয়ার্স পত্রিকায় এক প্রবন্ধে মার্কিন নৌশক্তির পতন সম্পর্কে সতর্ক করেন। প্রবন্ধতে তিনি ব্রুস জোন্সের ‘রোলিং দ্য ওয়েভস’ এবং গ্রেগ ইস্টারব্রুকের ‘দ্য ব্লু এইজ’ বই দু’টির আলোকে যুক্তি দেন যে মার্কিন নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি অনেকাংশেই সামুদ্রিক আধিপত্যের উপর নির্ভরশীল। তারা সতর্ক করেন, বিশ্ব বাণিজ্যিক পানিসীমা আবারো সহিংসতার মঞ্চে রূপ নিতে পারে।

শ্যাক যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর অবনতির একটি উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেন। সেজন্য তিনি চীনের তুলনায় কমসংখ্যক যুদ্ধজাহাজ, বিভিন্ন দুর্ঘটনা, রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি এবং নৌশক্তি বিকাশে বাজেট কমে যাওয়ার মতো ইস্যুগুলোকে সামনে নিয়ে আসনে, যা এখনো অব্যাহত।

বিশ্লেষণে শ্যাক উল্লিখিত দুই বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ পর্যালোচনা করেন এবং মার্কিন নৌশক্তির পতনের প্রেক্ষিতে বইগুলোর তাৎপর্য তুলে ধরেন।

১৮৯৭ সালে ইউরোপের মহাদেশীয় শক্তিগুলোর ক্রমবর্ধমান নৌজোটের হুমকি নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট অ্যাডমিরাল লর্ড জর্জ গোশেনকে জিজ্ঞেস করে, এত বিপুল সংখ্যক ইউরোপীয় জাহাজের মোকাবেলায় যুক্তরাজ্য কী করবে। গোশেন উত্তরে বলেন, ‘ভালো অ্যাডমিরালের উপর আস্থা রাখুন।’ অর্থাৎ যুক্তরাজ্যের কাছে এ চ্যালেঞ্জের কোনো কার্যকর উত্তর ছিল না।

আজ চীনের দ্রুত উত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থাও যেন অনেকটা একই। বহু বছর ধরে আমেরিকা বিশ্বাস করে এসেছে যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে সাথে চীন গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিকভাবে উদার হয়ে উঠবে। কিন্তু বেইজিংয়ের কর্তৃত্ববাদী শাসন সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে। এখন চীনের হুমকি মোকাবেলায় মার্কিন জনগণ যেন কেবল দক্ষ অ্যাডমিরালদের ওপরই ভরসা করতে পারে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ক্রমেই বেইজিংয়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। বস্তুত বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যকার প্রতিযোগিতা এখন নৌশক্তির লড়াইয়ে পরিণত হচ্ছে, যা অনেকেই উপলব্ধি করতে ব্যর্থ।

নৌ বিশ্লেষকরা ব্যঙ্গ করে বলেন, চীনের সাথে যুদ্ধ শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত প্রথমে ক্যালিফোর্নিয়ার লং বিচ বন্দরে হামলা করা। কারণ চীনের সাথে বাণিজ্য ব্যাহত হলে সেটিই বেইজিংয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর হবে।

বাস্তবতা হলো, আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইন এতটাই আন্তঃনির্ভরশীল যে চীনে কোভিড-১৯ মহামারিজনিত দেরির প্রভাবে লং বিচ বন্দরে কনটেইনার জাহাজের ব্যাপক জট তৈরি হয়েছিল। পরিস্থিতি এতটাই সঙ্কটাপন্ন ছিল যে বাইডেন প্রশাসন বাধা দূর করতে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েনের কথাও বিবেচনা করেছিল।

কোভিড-১৯ মহামারির ফলে এই বৈশ্বিক সংযোগ সম্পর্কে সচেতনতা বেড়েছে। কিছু সরকার তাদের শিল্প খাত পুনঃবিন্যাসের কথা ভাবতে বাধ্য হয়েছে। তবে অর্থনীতিকে একসূত্রে গাঁথা বিনিয়োগ, যোগাযোগ ও উৎপাদন নেটওয়ার্কগুলো আরো বিস্তৃত হচ্ছে।

সমুদ্রপথ ও জ্বালানি এই বৈশ্বিক নেটওয়ার্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ, বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ পণ্য পরিবহন হয় সমুদ্রপথে। যদিও ২১ শতকের কৌশলগত আলোচনার কেন্দ্রে সাইবারস্পেস ও মহাকাশ প্রতিযোগিতাও রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নিকট ভবিষ্যতে অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক ঘটনা ঘটবে সেই পুরনো ও পরিচিত মঞ্চেই- সমুদ্রে।

এই প্রেক্ষাপটে ব্রুস জোন্সের রোলিং দ্য ওয়েভস ও গ্রেগ ইস্টারব্রুকের দ্য ব্লু এইজ বই দুটি সমুদ্রভিত্তিক চ্যালেঞ্জ বিশ্লেষণ করে এবং আধুনিক নৌশক্তির তাৎপর্য তুলে ধরে। বইগুলো নৌ কৌশলবিদ ও ইতিহাসবিদ আলফ্রেড থায়ার মাহানের দৃষ্টিভঙ্গির ধারাবাহিকতায় রচিত, যিনি বলেন, ‘সমুদ্রশক্তির ইতিহাস মূলত সামরিক ইতিহাস।’

দু’টি বই-ই যুক্তি দেয় যে মার্কিন নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি সামুদ্রিক আধিপত্যের উপর নির্ভরশীল। উভয় বইয়ের লেখক সতর্ক করেন যে বিশ্ব বাণিজ্যিক পানিসীমা আবারো সহিংসতায় পর্যবসিত হতে পারে। যদিও এই বিশ্লেষণ কিছু বিশেষজ্ঞকে বিরক্ত করতে পারে, বেশিরভাগ পাঠকের জন্য এটি চীনের উত্থান, সমুদ্র অর্থনীতি এবং জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে প্রয়োজনীয় অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।

রেজিং ওয়েভস
জোন্স একটি সাংবাদিকতাসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। তার বক্তব্য ও বিশ্লেষণের ভিত্তি মূলত সাক্ষাৎকার ও ব্যক্তিগত কথোপকথনের বিবরণ। দৈনন্দিন বাণিজ্য ও যোগাযোগে সমুদ্রের গুরুত্ব বোঝাতে তিনি সমুদ্রের তলদেশে বিস্তৃত জ্বালানি পাইপলাইন ও ডেটা কেবলের মানচিত্র তুলে ধরেন। এর মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চান, বৈশ্বিক অর্থনীতি কতটা সমুদ্র পরিবহনের উপর নির্ভরশীল। তিনি জোর দিয়ে বলেন, সমুদ্র ‘শক্তি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক লড়াইয়ে বিস্ময়করভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।’

জোন্স প্রমাণ করতে চান যে বিশ্বের মহাসাগরগুলো দ্রুত বিশ্বের প্রধান সামরিক শক্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সঙ্ঘর্ষক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে।’ তিনি যুক্তি দেন, বিংশ শতাব্দীতে প্রচলিত সহযোগিতার ধারা ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে, যা বড় ধরনের সঙ্ঘাতের পথ প্রশস্ত করছে এবং ভূরাজনৈতিক সংঙ্ঘর্ষ এখন সমুদ্রে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে।

এই হতাশাজনক পূর্বাভাসের প্রেক্ষিতে জোন্স মার্কিন নৌ-আধিপত্যের পতনের বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তবে তার সুপারিশগুলো বাস্তবতাবর্জিত এবং বিশ্লেষণাত্মক কঠোরতা থেকে বঞ্চিত। উদাহরণস্বরূপ, তিনি একটি ‘জোটের জোট’ গঠনের আহ্বান জানান, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সমস্ত শক্তিনির্ভর অর্থনীতির মধ্যে বৈশ্বিক সহযোগিতা সমন্বয় করবে। তিনি ওয়াশিংটনকে ‘বিশ্বায়নে বিজয়ী ও পরাজিতদের সমস্যা সমাধান’ এবং ‘কার্বন নিঃসরণ কমাতে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহণ’ করার আহ্বান জানান। কিন্তু কিভাবে এসব কার্যকর করা হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি।

ইস্টারব্রুকও মার্কিন নৌ-আধিপত্য রক্ষার পক্ষে। তবে তিনি ভিন্ন পথ অনুসরণ করেন। বইটি মূলত রাজনৈতিক বামপন্থীদের লক্ষ্য করে লেখা বলেই মনে হয়। কারণ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘অনেক মানুষ সামরিক সংগঠন পছন্দ করেন না।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা কেন তাদের ঘৃণা করি তার ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। আমরা সেই দিনের স্বপ্ন দেখতে পারি, যেদিন কোনো দেশেরই সেনাবাহিনী বা নৌবাহিনীর দরকার হবে না।’ কিছুটা ভারসাম্য আনার উদ্দেশ্যে ইস্টারব্রুক ‘মার্কিন নৌবাহিনীর পক্ষে উদার যুক্তি’ তুলে ধরেন, যুক্তি দেন- এই শক্তি ‘উন্নয়নশীল বিশ্বে দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সহায়তা করেছে।’

ইস্টারব্রুক আরো বলেন, মার্কিন নৌবাহিনীর আধিপত্য বজায় রাখার পাশাপাশি ওয়াশিংটন বন্দর-কল বৃদ্ধি, মিত্রদের সুরক্ষার জন্য নতুন ঘাঁটি স্থাপন এবং নৌ-চলাচলের স্বাধীনতা প্রয়োগের মাধ্যমে নৌবাহিনীর বিশ্বব্যাপী উপস্থিতি জোরদার করতে পারে। তবে তিনি নিজেই যুক্তিটি দুর্বল করে বলেন যে মার্কিন জাতীয় ঋণ এতটাই বেশি যে এ ধরনের পদক্ষেপ আর্থিকভাবে বাস্তবায়ন করা কঠিন।

জোন্সের মতো, ইস্টারব্রুকও বিভিন্ন নীতিগত প্রস্তাব দেন। কিন্তু বিকল্পগুলোর মূল্যায়ন খুব কমই করেন। তবে ইস্টারব্রুক জোন্সের চেয়ে বেশি আদর্শবাদী মনে হয়। তিনি একটি ‘বিশ্ব মহাসাগর সংস্থা’ গঠনের প্রস্তাব দেন, যা শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, অফশোর জ্বালানি প্রকল্প তত্ত্বাবধান, মুক্ত বাণিজ্যের বাস্তবায়ন এবং আন্তর্জাতিক জলসীমায় পরিবেশগত মান বজায় রাখার জন্য একটি ‘সত্যিকারের বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা’ গড়ে তুলবে।

তবে লেখকদের কিছু ভুল তাদের বিশ্লেষণ ও দিকনির্দেশনার বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। উদাহরণস্বরূপ, জোন্স ১৯৫৬ সালের সুয়েজ সঙ্কটকে ‘প্রথম মুহূর্তগুলোর একটি’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, যখন শীতল যুদ্ধ প্রকৃত সঙ্ঘাতে পরিণত হতে পারতো। অথচ ১৯৪৮-৪৯ সালের বার্লিন অবরোধ এবং কোরিয়ান যুদ্ধের সৃষ্ট সঙ্কট আরো উপযুক্ত উদাহরণ।

অন্যদিকে, ইস্টারব্রুক ভুলভাবে দাবি করেছেন যে ‘যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অন্যান্য দেশের মতোই প্রায় সমানসংখ্যক আধুনিক, মোতায়েনযোগ্য নৌযান রয়েছে। যদিও বাস্তবে কেবল চীনেরই যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় বড় নৌবাহিনী রয়েছে।’

ইস্টারব্রুক চীন-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনার জন্য ‘আমেরিকান সামরিক-শিল্প জটিলতা, মুদ্রাস্ফীতি এবং সাংবাদিকদের উদ্বেগকে’ দায়ী করেন। ফলে চীনের দায় এড়িয়ে যান।

দক্ষিণ চীন সাগর প্রসঙ্গে যেখানে বেইজিং নিয়মিতভাবে অন্যান্য দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করছে এবং কৃত্রিম দ্বীপ গড়ে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে, সেখানে ইস্টারব্রুক উপসংহারে বলেন, ‘এই পানিসীমা এখন পর্যন্ত বেশিরভাগই শান্তিপূর্ণ ও সহিংসতামুক্ত, যার জন্য পশ্চিমা দৃষ্টিকোণে চীন কোনো কৃতিত্ব পায় না।’

সমুদ্র উত্তপ্ত

তাদের ত্রুটি সত্ত্বেও দু’টি বইই বিশেষজ্ঞ বিষয় সাধারণ পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করার একটি প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা। বিশ্বায়ন, চীনের উত্থান এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাধারণ আমেরিকানদের নৌসংক্রান্ত বিষয় এবং এ ক্ষেত্রে তাদের দেশের ভূমিকা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা অর্জন প্রয়োজন।

জোন্স ও ইস্টারব্রুক যে অবনতিশীল বৈশ্বিক শৃঙ্খলার কথা বলেছেন, তা টিকিয়ে রাখতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক ও বেসামরিক নৌশক্তি পুনর্গঠন করতে হবে, যেটি এখন উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত।

তারা যে বৈশ্বিক আন্তঃসংযোগের প্রশংসা করেছেন, তা সম্ভব হয়েছে বড় বড় বেসরকারি লজিস্টিক কোম্পানিগুলোর উত্থানের কারণে, যারা এখন মার্কিন মার্চেন্ট মেরিনের তুলনায় অনেক বড়। অথচ যুদ্ধের সময় মার্কিন সামরিক কর্মকাণ্ড চালাতে এই মার্চেন্ট মেরিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৫০ সালে বিশ্বজুড়ে জাহাজ চলাচলের ৪৩ শতাংশ ছিল মার্কিন বণিক নৌবহরের হাতে। ১৯৯৪ সালে তা নেমে আসে মাত্র ৪ শতাংশে। অবশ্য ১৯২০ সালের একটি আইনে বলা হয়েছে, মার্কিন বন্দরগুলোর মধ্যে চলাচলকারী জাহাজগুলোর নির্মাণ, নিবন্ধন ও পরিচালনা অবশ্যই আমেরিকানদের মাধ্যমে হতে হবে।

বর্তমানে মাত্র ৩৯৩টি জাহাজ নিয়ে গঠিত মার্কিন বণিক নৌবহর বিশ্বে ২৭তম স্থানে রয়েছে। এর বিপরীতে, চীনের রয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বণিক বহর। এতে তাদের আধাসামরিক মাছ ধরার নৌবহর অন্তর্ভুক্ত নয়, যেগুলো বিতর্কিত জলসীমায় অভিযান চালানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। (সিআইএ ফ্যাক্টবুক অনুযায়ী, মার্কিন বণিক নৌবহর বর্তমানে সপ্তম এবং চীন তৃতীয় স্থানে রয়েছে।)

এখানে মূল সমস্যা হলো, বৃহৎ বণিক নৌবহরের অভাবে যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত তার নৌবাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে—যেটি নিজেই তীব্রভাবে সঙ্কুচিত হচ্ছে। ১৯৩০ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজ সংখ্যা আজকের চেয়েও বেশি ছিল। অপরদিকে, ২০২০ সালে চীন বিশ্বের বৃহত্তম নৌশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে।

২০৩৪ সালের মধ্যে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ ৩০৬ থেকে ৩৫৫টি জাহাজে নৌবহর সম্প্রসারণের যে লক্ষ্য স্থির করেছে, তা এখনো অধরা স্বপ্নই রয়ে গেছে। কারণ কংগ্রেস এখনো সেই অনুযায়ী তহবিল বরাদ্দ করেনি।

বর্তমানে মার্কিন সামরিক কৌশল ইতোমধ্যেই সীমিত বাহিনীর ওপর তীব্র অপারেশনাল চাপ সৃষ্টি করছে। চীনের সাথে সম্ভাব্য সঙ্ঘাতের প্রস্তুতি, ন্যাটো মিত্রদের রক্ষায় ইউরোপে সৈন্য মোতায়েনের প্রতিশ্রুতি এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে সামরিক মহড়া ও বন্দর কল ব্যবহারের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী চরম চাপের মধ্যে রয়েছে।

বাইডেন প্রশাসন ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’র নীতির বিপরীতে গিয়ে প্রকাশ্যে তাইওয়ানকে রক্ষার অঙ্গীকার করে এই চাপ আরো বাড়িয়েছে। সামগ্রিকভাবে এত দায়িত্ব বর্তমান বাহিনী দিয়ে পালন করা সম্ভব নয়।

যুদ্ধ পরিকল্পনার দায়িত্বে থাকা কমান্ডাররা এমন একটি বাহিনীর ওপর বিশাল চাপ দিচ্ছেন, যা তাদের সামর্থ্য ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ‘চাহিদা’ আর ‘সরবরাহ’-এর মধ্যে ফারাক এতটাই যে ৫০০ জাহাজের বহর দিয়েও তা পূরণ করা সম্ভব নয়। প্রতি বছর প্রায় ২০টি জাহাজ মোতায়েন হয় এবং বিমানবাহী রণতরীগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াই বারবার মোতায়েন করা হয়, যা বাহিনীর সদস্যদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

নৌবাহিনীর প্রতিশ্রুতি ও বাস্তব সক্ষমতার এই ফারাক ক্রমবর্ধমান সামুদ্রিক দুর্ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ইউএসএস হ্যারি এস ট্রুম্যান দু’টি এফ/এ-১৮ সুপার হর্নেট হারিয়েছে। একটি নিজেদের গুলিতে এবং আরেকটি হাউছিদের গুলি এড়াতে গিয়ে দুর্ঘটনায়। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে থাকলেও নৌ নিরাপত্তা কমান্ডের প্রতিবেদন অনুযায়ী মারাত্মক (ক্যাটাগরি এ) দুর্ঘটনার হার বেড়েছে, যেগুলোর ক্ষয়ক্ষতি ২৫ লাখ ডলারের বেশি, যা এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।

গত তিন বছরে সামুদ্রিক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বেড়েছে- ২০২২ ও ২০২৩ সালে আটজন করে এবং ২০২৪ সালে দশজন। ২০২১ সালে গভর্নমেন্ট অ্যাকাউন্টেবিলিটি অফিস এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী করেছিল ক্রু ঘাটতি, ক্লান্তি ও প্রশিক্ষণের অভাবকে। ২০১৮ সালের এক অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নে দেখা যায়, ৮৫ শতাংশ জুনিয়র অফিসারের জাহাজ পরিচালনার প্রাথমিক দক্ষতাও নেই।

এই অপারেশনাল সঙ্কট আরো জটিল হয়ে ওঠে প্রশাসনিক সঙ্কটের কারণে। ২০২২ সালের কংগ্রেস রিপোর্টে সমালোচনা করা হয় যে নৌবাহিনীতে যুদ্ধ প্রশিক্ষণের চেয়ে প্রশাসনিক কাজকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। ঝুঁকি এড়িয়ে চলা এবং কঠোর আমলাতান্ত্রিক মান মেনে চলা জাহাজ কমান্ডারদের বেশি মূল্যায়ন করা হয়।

অনেক অফিসার মনে করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিংবদন্তি কমান্ডার চেস্টার নিমিটজ আজকের এই আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে টিকতে পারতেন না। ইতিহাসবিদ অ্যান্ড্রু গর্ডন দুই ধরনের সেনার কথা বলেন, ‘র‍্যাটক্যাচার’, যারা নিয়ম ভেঙে যুদ্ধ জেতে। আর ‘অর্ডলি’, যারা নিয়ম মেনে শান্তিকালে পদোন্নতি পায় কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হয়। প্রশাসনিক কাজকে অগ্রাধিকার দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন একটি ‘অর্ডলি’ নৌবাহিনী গড়ে তুলছে, যার যুদ্ধ দক্ষতা প্রশ্নসাপেক্ষ।

এই সংস্কৃতি অনেক সময় শীর্ষ নেতৃত্ব থেকেই আসে। বাইডেন প্রশাসন তার অগ্রাধিকার দিয়েছিল কোভিড-১৯, অর্থনৈতিক মন্দা, জাতিগত ন্যায়বিচার ও জলবায়ু সঙ্কট মোকাবেলায়। প্রতিরক্ষা বিভাগের সোশ্যাল মিডিয়া এসব বিষয়েই বেশি গুরুত্ব দেয়। যদিও এগুলো গুরুত্বপূর্ণ, এগুলো সামরিক বাহিনীর মূল উদ্দেশ্য নয়।

প্রয়োজনীয় জনবল, সরঞ্জাম ও তহবিল হ্রাস না করেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। উল্লেখযোগ্য যে ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় ফিরে বৈচিত্র্য নীতি বাতিল করেছে। পেন্টাগনের ‘সমন্বিত প্রতিরোধ’ নীতি সামরিক শক্তি নয়, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক পথে শত্রু দমনকে গুরুত্ব দেয়।

বাজেট ঘাটতি দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন সামরিক প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। যেমন, বাইডেনের প্রস্তাবিত ২০২২ বাজেটে প্রতিরক্ষা বিভাগই ছিল একমাত্র সংস্থা, যার তহবিল বাড়েনি। অন্যদিকে অন্য সব সংস্থার বাজেট গড়ে ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।

এছাড়া, প্রশাসন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শক্তি বৃদ্ধির জন্য ‘প্যাসিফিক ডিটারেন্স ইনিশিয়েটিভ’-এ অর্থায়নে অনীহা দেখিয়েছে, যেটিকে বিশ্লেষকেরা চীন প্রতিরোধে অপর্যাপ্ত মনে করেন।

ইতিমধ্যে বাইডেন প্রশাসন প্যাসিফিক ডিটারেন্স ইনিশিয়েটিভের মতো কর্মসূচিতে অর্থায়নে অস্বীকৃতি জানায়, যার মাধ্যমে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সেনাবাহিনীতে বিনিয়োগের প্রয়োজন ছিল। অধিকাংশ সামরিক বিশেষজ্ঞের মতে, এটি চীনকে নিরস্ত করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ওই সময় বাইডেন প্রশাসনের প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা বাজেট এতটাই অপর্যাপ্ত ছিল যে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস প্রশাসনের অনুরোধে অতিরিক্ত ২৪ বিলিয়ন ডলার যুক্ত করে। পরবর্তী বছরগুলোতে প্রশাসন সামরিক তহবিলের ঘাটতির ঝুঁকি উপলব্ধি করে এবং ২০২৩ সালে প্রতিরক্ষা বাজেট ৮৫৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করে, যা তখন পর্যন্ত মার্কিন ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এরপর ২০২৪ সালে এটি বেড়ে হয় ৮৮৬ বিলিয়ন এবং ২০২৫ সালে ৮৯৫ বিলিয়ন ডলার। ওভাল অফিস ছাড়ার কয়েক সপ্তাহ আগে বাইডেন প্রশাসন এই বাজেট অনুমোদন করে। আজ ট্রাম্প প্রশাসন ২০২৬ সালে প্রতিরক্ষা ব্যয় ১৩ শতাংশ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যার ফলে বাজেট ১ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। একইসাথে শিক্ষা, বৈদেশিক সাহায্য, জ্বালানি ও পরিবেশ সুরক্ষায় ১৬৩ বিলিয়ন ডলার কমানো হবে। ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এই অতিরিক্ত ব্যয়ের একটি অংশ সম্ভবত যুদ্ধজাহাজ নির্মাণে ব্যবহৃত হবে। তবে দেশের ক্রমবর্ধমান প্রতিরক্ষা চাহিদা মেটাতে এই ব্যয়ের মাত্রা দীর্ঘ সময় ধরে বজায় রাখা বা আরো বাড়ানো প্রয়োজন হবে।

প্রায় দুই দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক সক্ষমতা এবং ঘোষিত কৌশলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধান সহ্য করে আসছে। এই সমস্যা সমাধানে ওয়াশিংটনকে হয় তার লক্ষ্য সংকুচিত করতে হবে, নয়তো ক্রমাগত ব্যয় বাড়াতে হবে, অথবা সামরিক কর্মক্ষমতা বাড়াতে বিপ্লবী উপায় খুঁজে বের করতে হবে। মিত্ররা কিছু তহবিল ঘাটতি পূরণে সহায়তা করতে পারে। কিন্তু তা কখনোই পুরোপুরি যথেষ্ট হবে না।

সমুদ্রে পরিবর্তন

উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ব্রিটেনের আধিপত্য অনেকাংশেই নির্ভর করেছিল সমুদ্র নিয়ন্ত্রণের ওপর। তবে রেলপথের উত্থান স্থলপথে বাণিজ্য ও যোগাযোগকে সহজ করে ব্রিটিশ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। আজ যুক্তরাষ্ট্রও একই ধরনের ঝুঁকির মুখে- প্রযুক্তিগত ও কার্যকরী অগ্রগতি হয় তার সামরিক আধিপত্যকে দুর্বল করতে পারে, নয়তো তাকে তার সীমার বাইরে ঠেলে দিতে পারে।

যদিও সমুদ্রশক্তির গুরুত্ব নিয়ে বারবার আলোচনা হয়েছে, জোন্স বা ইস্টারব্রুক কেউই আধুনিক নৌযুদ্ধ এবং এর পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার দিকে যথেষ্ট মনোযোগ দেন না। উদ্ভাবন হওয়া উচিত আমেরিকান সামরিক বাহিনীর অন্যতম শক্তির উৎস। প্রতিরক্ষা ব্যয়েও এই অগ্রাধিকার প্রতিফলিত হওয়া উচিত।

মার্কিন সেনাবাহিনী একাধিক পরীক্ষামূলক অপারেশন চালিয়েছে, যার ফলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। যেমন মেরিন কর্পসের উভচর অভিযানে ফিরে যাওয়া এবং ছোট, মোবাইল ইউনিটে বিনিয়োগ। আমেরিকান স্বার্থ রক্ষায় এই উন্নয়নগুলো প্রয়োজনীয় হলেও তা যথেষ্ট নয়; আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, এসব পরিবর্তন যথেষ্ট দ্রুত ঘটছে না।

যদিও ট্রাম্প ও বাইডেনের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে তারা একমত যে চীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সামরিক হুমকি এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলই সম্ভাব্য সঙ্ঘাতের প্রধান মঞ্চ- যা স্পষ্টতই সামুদ্রিক। তাই প্রতিরক্ষা ব্যয়ে এই বাস্তবতা প্রতিফলিত হওয়া উচিত। শুধু বাজেট বাড়িয়ে নয়, বরং বিমান বাহিনী ও সেনাবাহিনীর তুলনায় নৌবাহিনীকে অগ্রাধিকার দিয়েও।

নৌবাহিনীর শক্তি নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি সক্ষম ও সুসম্পদের নৌবাহিনী ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র তার জাপান ও ফিলিপাইনের মিত্রদের রক্ষা করতে বা বৃহত্তর সঙ্ঘাতের মঞ্চ সুরক্ষিত রাখতে পারবে না। এই দিক থেকে জোন্স ও ইস্টারব্রুক একদম সঠিক। সমুদ্র নিয়ন্ত্রণই আগামী শতাব্দীর ভাগ্য নির্ধারণ করবে।

যুক্তরাষ্ট্র একটি ‘অপ্রচলিত’ আধিপত্যবাদী শক্তি। কারণ এটি নিজে যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়েছে, তাতে অংশগ্রহণে অনিচ্ছুক। যেমন, ওয়াশিংটন জাতিসঙ্ঘের সমুদ্র আইন কনভেনশনের আলোচনায় নেতৃত্ব দিয়েছিল, যা ‘মহাসাগরের জন্য একটি সংবিধান’ তৈরি করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কখনো এই কনভেনশন অনুমোদন করেনি। প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র দফতরের আহ্বান সত্ত্বেও বাণিজ্যিক স্বার্থ, বিশেষত গভীর সমুদ্র খনির প্রশ্নে কংগ্রেসকে কনভেনশন অনুমোদনে নিরুৎসাহিত করেছে।

এই আনুষ্ঠানিক অনিচ্ছার ফলে যুক্তরাষ্ট্র শুধু নিজে এই চুক্তি মানে না, বরং অন্যদের ওপরও তা চাপিয়ে দেয়। অনেক দেশ একে ‘ব্যতিক্রমী আমেরিকান আচরণ’ বলে মনে করে, যখন ওয়াশিংটন সুবিধা নেয় কিন্তু কনভেনশন মানতে অস্বীকার করে। ফলে আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা দুর্বল হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রকে একটি অবিশ্বস্ত মিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই প্রেক্ষাপটে, নৌশক্তি জোরদারে অনীহা মিত্র ও অংশীদারদের কাছে ভুল বার্তা পাঠায়। যদি যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার নিয়ম প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োগে নেতৃত্ব ধরে রাখতে চায়, তবে তাদের পুরনো একটি পরামর্শ মনে রাখতে হবে। কখনো সমুদ্রের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন না।

সূত্র : আল জাজিরা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top