যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসন প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ অনথিভুক্ত অভিবাসীদের গণবহিষ্কারের নীতি বাস্তবায়নে নমনীয়তার ইঙ্গিত দিয়েছে। সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে অভিবাসীদের লক্ষ্য করে পরিচালিত পুলিশি অভিযানের পর শুরু হওয়া বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে এই অবস্থান পরিলক্ষিত হয়।
ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রায় ২০ লাখ অনথিভুক্ত অভিবাসী বসবাস করেন। রাজ্যটিতে তাদের উপস্থিতি নিয়ে আইন ও নিরাপত্তার প্রশ্নের পাশাপাশি ব্যাপকভাবে আলোচনায় উঠে এসেছে এর অর্থনৈতিক দিক। অধিকাংশ অভিবাসী ল্যাটিন আমেরিকার দেশ, বিশেষ করে মেক্সিকো থেকে আগত। তারা কৃষি, নির্মাণ, আতিথেয়তা এবং অন্যান্য শ্রমনির্ভর খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) কর্মকর্তাদের হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং কৃষিক্ষেত্রে অভিবাসী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধ রাখতে বলেছে। প্রতিবেদনে উঠে আসে, গণবহিষ্কারের ফলে অর্থনৈতিক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যেখানে ট্রাম্পের অনেক রাজনৈতিক সমর্থক সরাসরি জড়িত।
নিজের ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ‘আমাদের মহান কৃষক, হোটেল এবং বিনোদন কর্মীরা বলছেন, আমাদের কঠোর অভিবাসন নীতির কারণে তারা দক্ষ এবং বিশ্বস্ত কর্মী হারাচ্ছেন। এই কর্মীদের পরিবর্তে নতুন লোক নিয়োগ করা অত্যন্ত কঠিন।’
এই অবস্থান পূর্বে ঘোষিত ট্রাম্পের কঠোর অবস্থানের সাথে সাংঘর্ষিক। তিনি একসময় ১৯৫০-এর দশকের অপারেশন ওয়েটব্যাকের নজির ভাঙার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যার মাধ্যমে প্রায় ১৩ লাখ মেক্সিকান ও মেক্সিকান-আমেরিকানকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল।
নতুন এই অবস্থান হোয়াইট হাউসের অভ্যন্তরেও মতবিরোধ সৃষ্টি করেছে। ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ স্টিফেন মিলার এবং হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সেক্রেটারি ক্রিস্টি নোয়েম অভিবাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিদিন ৩,০০০ গ্রেফতারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন, যেখানে ফেব্রুয়ারি ও মার্চে গড় গ্রেফতারের সংখ্যা ছিল ৪০০।
স্টিফেন মিলার দীর্ঘদিন ধরে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ার পক্ষে। তবে বাস্তবতা হলো, হোয়াইট হাউস যেখানে অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ বলে দাবি করছে, সরকারি পরিসংখ্যানে সেটি মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অনথিভুক্ত অভিবাসীদের গণবহিষ্কারের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ১.১ থেকে ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত সংকুচিত হতে পারে। এই সংকোচন ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার তুলনায়ও বেশি হতে পারে বলে সতর্ক করেছে অলাভজনক সংস্থা ‘আমেরিকানস ফর ট্যাক্স ফেয়ারনেস’।
২০২৩ সালের কর তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪৭.৮ মিলিয়ন অভিবাসী প্রায় ৬৫২ বিলিয়ন ডলার কর প্রদান করেছেন। এর মধ্যে অনথিভুক্ত অভিবাসীরা একাই প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলার কর দিয়েছেন, যার মধ্যে ফেডারেল কর ৫৫.৮ বিলিয়ন এবং রাজ্য ও স্থানীয় কর ৩৩.৯ বিলিয়ন ডলার।
তবে এই বিশাল কর অবদানের পরও অধিকাংশ অনথিভুক্ত অভিবাসী সামাজিক নিরাপত্তা ও কর-ছাড় সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন।
অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমশক্তির প্রায় ৫ শতাংশ গঠন করে এবং নির্মাণ খাতে প্রতি ৭ জনে ১ জন, কৃষিতে প্রতি ৮ জনে ১ জন এবং হাসপাতাল খাতে প্রতি ১৪ জনে ১ জন অভিবাসী কর্মরত আছেন। বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রে, অনথিভুক্ত অভিবাসীরা দেশের ৫০ শতাংশ ফসল কাটার শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন, যা আমেরিকান কৃষির জন্য অপরিহার্য।
এদিকে, অভিবাসন আদালতগুলো বর্তমানে প্রায় ৩.৭ মিলিয়ন মামলার চাপে রয়েছে, যার ফলে বহু অনথিভুক্ত অভিবাসী বহিষ্কারের আইনি প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করার অধিকার পাচ্ছেন।
সূত্র : আল জাজিরা