ভারতের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান আইআইটি-তে ভর্তি হওয়ার পর পারস ও তার পরিবার আশা করেছিলেন, তাদের আর্থিক দুর্দশার অবসান হবে। কিন্তু ভারতের ফেডারেল সরকারের বিলম্বিত তহবিল বিতরণের কারণে তার পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। পারস সংক্রামক রোগ নিয়ে গবেষণা করছেন। কয়েক মাস ধরে ৩৭ হাজার রুপির মাসিক ফেলোশিপ পাচ্ছেন না। তার ফেলোশিপ ‘ইনস্পায়ার’ প্রকল্পের আওতায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ (ডিএসটি) অর্থায়ন করে।
ফেলোশিপ বিলম্বের কারণে ২০২২ সালে কেনা ল্যাপটপের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হন পারস। এতে তার ক্রেডিট স্কোর কমে যায় এবং সঞ্চয় ভেঙে পড়ে। খরা-প্রবণ অঞ্চলের কৃষক বাবা-মায়ের সহায়তা সম্ভব না হওয়ায় বন্ধুবান্ধব থেকে ধার নিতে বাধ্য হন তিনি।
এমন সঙ্কটে একা নন পারস। আল জাজিরা দেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘ইনস্পায়ার’ প্রোগ্রামের অধীনে অধ্যয়নরত বা সাবেক এক ডজন গবেষকের সাথে কথা বলেছে। তারা সবাই তিন থেকে নয় মাস পর্যন্ত ফেলোশিপ ছাড়াই ছিলেন। বিলম্ব ও প্রশাসনিক জটিলতায় তাদের গবেষণা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে।
গবেষকরা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজ্ঞানমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংকে ট্যাগ করে অভিযোগ জানিয়েছেন। ফেলো সায়ালি আটকারে লিঙ্কডইনে লেখেন, ‘এক বছরের বেশি সময় ধরে অনেকেই ফেলোশিপ পাচ্ছেন না। ফলে অনেক তরুণ গবেষক আর্থিক ও মানসিক চাপে আছেন।’
২০২৩ সালে গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্সে ভারত ১৩৩ দেশের মধ্যে ৩৯তম হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় এক ধাপ উন্নতি। সরকার একে ‘চিত্তাকর্ষক উল্লম্ফন’ বলে বর্ণনা করেছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি জানান, গত এক দশকে গবেষণায় সরকারের ব্যয় ৬০০ বিলিয়ন রুপি থেকে দ্বিগুণ হয়ে ১,২৫০ বিলিয়ন রুপিতে পৌঁছেছে; একইসাথে পেটেন্ট দাখিলের সংখ্যা ৪০ হাজার থেকে ৮০ হাজার ছাড়িয়েছে।
সরকারের দাবি, গবেষণা খাতে বিনিয়োগ, গবেষণা পার্ক এবং ফেলোশিপ তৈরি, এসব উদ্যোগ গবেষকদের সামনে প্রতিবন্ধকতা দূর করেছে। তবে সরকারি নথি, বাজেট বিশ্লেষণ ও গবেষকদের বক্তব্যে উঠে এসেছে ভিন্ন বাস্তবতা।
বলা হচ্ছে, সরকার মূলত বাণিজ্যিক গবেষণা, বিশেষত স্টার্টআপ ও বড় করপোরেশনগুলোর পণ্য উন্নয়নকেন্দ্রিক বিনিয়োগে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, চলতি অর্থবছরে ডিএসটি-এর বাজেটের ৭০ শতাংশ বরাদ্দ গেছে এমন একটি প্রকল্পে, যেখানে সেমিকন্ডাক্টরসহ কিছু নির্দিষ্ট খাতে গবেষণার জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সুদমুক্ত ঋণ দেয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে, ইন্সপায়র ফেলোশিপের মতো প্রকল্পে বরাদ্দ শুধু স্থবির না। উল্টো বাস্তবে কাটা পড়েছে। অথচ সরকার বলছে, তহবিল বাড়ানো হয়েছে। ফলে ভারতের উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়ছে। আর তরুণ গবেষকরা হতাশা ও আর্থিক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন।
কম বেতন ও বিলম্বিত তহবিলে ব্যাহত ভারতের গবেষণা, তরুণ বিজ্ঞানীরা হতাশ
ইনস্পায়ার প্রকল্পের লক্ষ্য হলো ‘গবেষণা ও উন্নয়নের ভিত্তি শক্তিশালী করতে প্রতিভাবান তরুণ বিজ্ঞানীদের আকৃষ্ট, সংযুক্ত ও লালন-পালন করা।’ এই প্রকল্পের আওতায় পিএইচডি ও অনুষদ ফেলোশিপ প্রদান করা হয় কৃষি, ক্যান্সার গবেষণা, জলবায়ু পরিবর্তন, নবায়নযোগ্য শক্তি ও ন্যানোপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
পিএইচডি ফেলোরা মাসিক ৩৭ হাজার থেকে ৪২ হাজার রুপি এবং বার্ষিক ২০ হাজার রুপি গবেষণা খরচ হিসেবে পান। অনুষদ ফেলোদের দেয়া হয় মাসিক ১ লাখ ২৫ হাজার রুপি এবং বার্ষিক ৭ লাখ রুপি অনুদান। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬৫৩ জন পিএইচডি ফেলো ও ৮৫ জন অনুষদ ফেলো এই প্রকল্পে নথিভুক্ত হয়েছেন।
তবে বাস্তবে মাসের পর মাস বেতন না পাওয়ার অভিযোগ করছেন ফেলোরা। পূর্ব ভারতের এক অনুষদ ফেলো বলেন, ‘২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বেতন পাইনি। তাই একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক সভায় অংশ নিতে পারিনি।’ অনেকে জানান, ফোন বা ইমেলের মাধ্যমে যোগাযোগ করেও স্পষ্ট উত্তর মেলেনি। কেউ কেউ অভদ্র আচরণেরও শিকার হয়েছেন। এক গবেষক মজা করে বলেন, ‘যদি কেউ ফোন ধরে, বুঝবেন আজ আপনার লটারি জিতেছে।’
মে মাসে ডিএসটি সচিব অভয় কারান্দিকার স্বীকার করেন যে তহবিল বিলম্ব হয়েছে। তবে তিনি জানান, জুন ২০২৫ থেকে নিয়মিত অর্থ বিতরণ শুরু হবে। তিনি দাবি করেন, ‘সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।’
ইনস্পায়ার প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা নানা অস্বচ্ছতা ও ত্রুটিতে ভরা। জানুয়ারিতে ‘তহবিল ব্যবহারের দক্ষতা’ নিশ্চিত করতে তিনটি আরঅ্যান্ডডি প্রকল্প বন্ধ করে ‘বিজ্ঞান ধারা’ নামে একটি নতুন প্রকল্প চালু করে কেন্দ্র। ইনস্পায়ার-এর অর্থায়ন এখন এই প্রকল্পের অধীন। ফলে নতুন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলাসহ প্রশাসনিক পরিবর্তনের কারণে আরো বিলম্ব হয়।
সরকার দাবি করে, বিজ্ঞান ধারায় বাজেট বেড়েছে ৩.৩০ বিলিয়ন রুপি থেকে ১৪.২৫ বিলিয়ন রুপিতে। কিন্তু এই হিসাব বিভ্রান্তিকর। বিজ্ঞান ধারা যে তিনটি প্রকল্প প্রতিস্থাপন করেছে, তাদের সম্মিলিত বার্ষিক বাজেট ছিল ১৮.২৭ বিলিয়ন রুপি। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে ২২ শতাংশ বাজেট হ্রাস পেয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে বিজ্ঞান ধারার প্রকল্পগুলোকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ৪৩.৮৯ বিলিয়ন রুপি থেকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ১৪.২৫ বিলিয়ন রুপিতে নামিয়ে আনা হয়েছে, যা ৬৭.৫ শতাংশ ছাঁটাই।
বাজেট হ্রাসের ব্যাখ্যা চেয়ে আল জাজিরার প্রশ্নে ডিএসটি কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
এদিকে, সরকার গবেষণার বাণিজ্যিকীকরণে জোর দিচ্ছে। বেসরকারি খাতের জন্য ২০০ বিলিয়ন রুপি বরাদ্দ করা হয়েছে, যা কম বা বিনা সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ হিসেবে দেয়া হবে। এর লক্ষ্য উৎপাদন বাড়ানো, পেটেন্ট দাখিল বৃদ্ধি ও মেধা পাচার রোধ।
কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালিত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা রয়ে গেছেন সমস্যায়। অল-ইন্ডিয়া রিসার্চ স্কলারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি লাল চন্দ্র বিশ্বকর্মা বলেন, সরকার বড় কথা বলছে। কিন্তু গবেষণাগারে যারা কাজ করেন, তারা ভুগছেন। মাসিক বৃত্তি সরকারি কর্মচারিদের বেতনের সমান হওয়া উচিত এবং তা সময় মতো দিতে হবে।’
এখন অনেক গবেষক বিদেশে পিএইচডি বা ফেলোশিপ করতে আগ্রহী। আইআইটির এক অধ্যাপক বলেন, ‘এটি কেবল অর্থের বিষয় নয়। গবেষণার সহজতা, সহায়ক কর্মী, প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা সবকিছু ইউরোপ ও আমেরিকায় অনেক উন্নত। ভারতে এগুলো কিছুই নেই।’
সূত্র : আল জাজিরা