সম্পাদকীয় ডেস্ক
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি এখন আর কেবল সাধারণ মানুষের ক্ষোভে সীমাবদ্ধ নয়—এটি ক্রমশ একটি রাষ্ট্রীয় এবং বিচারিক আলোচনার বিষয় হয়ে উঠছে। অনেকে হয়তো ভাবছেন, নিষিদ্ধ ঘোষণা হলেই দলটি রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায় নিষ্প্রভ হয়ে যাবে। কিন্তু ইতিহাস ও বাস্তবতা একথা বলে না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ছিল একটি দীর্ঘ সময়ের শাসক দল। শাসনকালে তারা যে দমন-পীড়ন, দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাস তৈরি করেছে, তাকে অপরাধ হিসেবে বিচারিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দলটির নেতৃত্ব ও সংশ্লিষ্টদের বিচারের আওতায় আনা একান্ত প্রয়োজন। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, শুধু দলটিকে নিষিদ্ধ করলেই কি তার আদর্শ, নেটওয়ার্ক বা রাজনৈতিক প্রভাব বিলীন হয়ে যাবে? তার উত্তর হলো, না। এতো সহজে তা হবে না।
কোনো গণভিত্তিসম্পন্ন দলকে কেবল প্রশাসনিক আদেশে নিষিদ্ধ করে দিলে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব মুছে ফেলা যায় না। আপনি খেয়াল করবেন, শেখ হাসিনার পতনের পরেও বহু কর্মী এখনো আত্মপরিচয়ে আওয়ামী লীগারই রয়ে গেছেন। তারা হয়তো আপাতত চুপ, কিন্তু প্রস্তুত—উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষায়। তারা এখনো বিশ্বাস করে, শেখ হাসিনাকে ড. ইউনুস কিংবা আমেরিকা ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা থেকে সরিয়েছে। তাদের একাংশ তো এখনো বিশ্বাস করে না যে আওয়ামী লীগ কোনো গণহত্যা ঘটিয়েছে।
এই মানসিকতা ভাঙতে হলে প্রয়োজন বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কার্যক্রম। শুধুমাত্র নিষিদ্ধ করে কিংবা রাজনৈতিক মাঠ থেকে সাময়িকভাবে সরিয়ে দিয়ে দলটিকে নিঃশেষ করা যাবে না।
কী করতে হবে?
এক. বিচারিক প্রক্রিয়ায় দায়ীদের জবাবদিহি করা
দলটির নেতৃত্ব ও সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের যথাযথ আইনি কাঠামোর মধ্যে এনে বিচার করতে হবে। তারা রাষ্ট্রের বিপক্ষে যা করেছে—তা ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হিসেবে থাকতে হবে।
দুই. সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা
‘৭১ সালের ঘটনা নিয়ে যত নাটক, সিনেমা, বই তৈরি হয়েছে, তার এক শতাংশও ‘জুলাই বিপ্লব’ বা আওয়ামী শাসনের অন্যায় নিয়ে হয়নি। কেন? মাহফুজ, নাহিদ বা আসিফরা কি শুধু বক্তৃতা দিয়েই দায় শেষ করেছেন? ফারুকীর মতো ক্ষমতাধর নির্মাতা কেন এখনো কোনো চলচ্চিত্র বানাতে পারেননি এই ঐতিহাসিক পটভূমিতে?
তিন. সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্নকরণ
আওয়ামী লীগকে শুধুমাত্র রাজনৈতিকভাবে নয়, সামাজিকভাবে ঘৃণিত এক পরিচয়ে পরিণত করতে হবে। যেন তারা আর গণমানুষের ভরসা অর্জন করতে না পারে। আদর্শের জায়গায় আঘাত না করলে দল নয়, বরং একটি নতুন রূপে আবার ফিরবে—হয়তো নতুন নামে, নতুন মোড়কে।
চার. জুলাই বিপ্লবের ধারাবাহিকতা রক্ষা
রাজপথে কয়েকদিনের উত্তেজনা যথেষ্ট নয়। এই বিপ্লবের ন্যারেটিভকে গণমাধ্যম, শিক্ষাব্যবস্থা, সাহিত্য ও নাট্যে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। একে স্বতন্ত্র ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে জাতির চেতনায় স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন।
আমরা স্পষ্ট করে বলি— এখন প্রয়োজন নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি তাদের বিচার করা। আরও প্রয়োজন—তাদের আদর্শিক ভিত্তিকে ধ্বংস করা, সাংস্কৃতিকভাবে পরাজিত করা এবং সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। শুধু দোষারোপ করে কাজ হবে না। ক্ষমতার ভেতরে ও বাইরে যারা আছেন—তাদের সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে।