আবারো ‘ভিকটিম কর্ড’ খেলছেন নেতানিয়াহু

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আবারো তার পুরনো কৌশল -‘ভিকটিম কর্ড’- খেলছেন। সর্বশেষ এক বক্তব্যে তিনি দাবি করেন, হামাস নাকি ‘ইহুদি রাষ্ট্রকে ধ্বংস’ এবং ‘ইহুদি জনগণকে নির্মূল’ করতে চায়। তবে এই বক্তব্য এসেছে এমন এক সময়ে, যখন ইসরাইল অধিকৃত ফিলিস্তিনে ‘স্বীকৃতি গণহত্যা’ চালাচ্ছে—যার সমালোচনা আরব বিশ্বের বাইরে, বিশেষত যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং কানাডা থেকেও জোরালোভাবে উঠেছে।

নেতানিয়াহুর ভাষ্য অনুযায়ী, এই সমালোচনার পেছনে যুক্তিগত বা নৈতিক কোনো ভিত্তি নেই; বরং তার মতে, সমালোচনাকারীরা এক ‘সরল সত্য’ বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন। অথচ এই তথাকথিত ‘সরল সত্য’ কোনোভাবেই সহজ নয়, বরং তা বাস্তবতাকে আড়াল করার একটি রাজনৈতিক অপকৌশল।

রাজনৈতিক ইহুদিবাদের ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, থিওডোর হার্জলের ‘দ্য জিউইশ স্টেট’ বইতে প্রতিফলিত মতবাদ শুরু থেকেই একটি জাতিগত নির্মূলনির্ভর পরিকল্পনার দিকে ইঙ্গিত করেছিল- একটি ‘ইউরোপীয় সভ্যতার ঘাঁটি’ গড়ে তুলতে ‘বর্বরতার সমুদ্রে’ ফিলিস্তিনকে উপেক্ষা করে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। এই দর্শনের ধারক-বাহকরাই পশ্চিমা নব্য-সাম্রাজ্যবাদীদের সমর্থনে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে।

নেতানিয়াহুর অভিযোগ -হামাস ইহুদি জনগণকে নির্মূল করতে চায়- ফিরিয়ে দেয়া যায় তার নিজের রাষ্ট্রের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের আগে থেকেই তারা একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করতে কাজ করেছে। ৭৭ বছরের ধারাবাহিক দখলদারিত্ব, হত্যা ও বাস্তুচ্যুতির মাধ্যমে ফিলিস্তিনি জনগণকে নিঃশেষ করার যে প্রচেষ্টা চলছে, সেটিই এই প্রকৃত ইতিহাসের প্রমাণ।

ইসরাইলের রাষ্ট্রায়ত্ত উগ্রবাদ, যার জন্ম ব্রিটিশ ম্যান্ডেট আমলে ইরগুন ও স্টার্ন গ্যাংয়ের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে, পরবর্তীতে রাষ্ট্রের মূলনীতিতে পরিণত হয়েছে। এদের নেতারাই পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হন, যার মধ্যে মেনাচেম বেগিন ও ইতজাক শামির অন্যতম। এসব নেতার কার্যক্রমের একটি তালিকা থেকেই ইঙ্গিত মেলে যে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম ও বিকাশ সন্ত্রাসবাদের ওপর নির্ভর করে।

আজকের বাস্তবতায়, যখন গাজায় বেসামরিক মানুষ হত্যার পাশাপাশি পশ্চিমতীর ও পূর্ব জেরুজালেমে অবৈধ বসতি স্থাপন ও দখল কার্যক্রম চলমান, তখন নেতানিয়াহুর ‘ভিকটিম কার্ডের ভাষ্য’ সর্বাধিক ভণ্ডামিপূর্ণ বলেই প্রতীয়মান হয়। অথচ তিনি হামাসের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, অপহরণ, শিশু হত্যা ইত্যাদি গুরুতর অভিযোগ আনেন- যা গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর দীর্ঘদিনের অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে আত্মপক্ষসমর্থনের একটি প্রচেষ্টা মাত্র।

বিশ্ব গণমাধ্যমের দৃষ্টি এড়াতে নেতানিয়াহু আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বদের যেমন কেয়ার স্টারমার, ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, ও মার্ক কার্নিকে দোষারোপ করছেন ‘হামাসকে উৎসাহ দেয়ার’ জন্য। অথচ জাতিসঙ্ঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত ১৮ মাসে কমপক্ষে ১৭ হাজার ৫০০ ফিলিস্তিনি শিশু নিহত হয়েছে ইসরাইলি হামলায়, এবং ইসরাইলি কারাগারে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি বিচার ছাড়াই বন্দী।

নেতানিয়াহু নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন এক রাষ্ট্রকে, যে কখনো নিজের সীমানা নির্ধারণ করেনি; বরং ‘বৃহত্তর ইসরাইল’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলো পর্যন্ত দখলের স্বপ্ন লালন করে। তিনি এবং তার পূর্বসূরীরা পশ্চিমা সমর্থনের জোরে এই আগ্রাসী নীতিকে পরিচালনা করে এসেছেন।

ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখলের বাস্তবতা ঢাকতে নেতানিয়াহু আজও ভিকটিম তুলে ধরতে চান। কিন্তু তার সরকারের সদস্যদের গণহত্যার অভিপ্রায়সূচক প্রকাশ্য বক্তব্য এবং দীর্ঘদিনের বাস্তবতা প্রমাণ করে, জাতিগত নির্মূল বরাবরই ছিল ইহুদিবাদী রাজনীতির কৌশল। ১৯৪৮ সালের নাকবা কোনো এককালীন দুর্ঘটনা নয়; এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।

৭ অক্টোবরের ঘটনাকে বর্তমান সঙ্ঘাতের সূচনাবিন্দু হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা হলেও বাস্তবে এটি ফিলিস্তিনে ইসরাইলের দখলদারিত্ব ও উপনিবেশ স্থাপনের ফল এবং পরিপ্রেক্ষিতেই ঘটেছে। বর্তমানে ৫৪ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। ১১ হাজারের বেশি নিখোঁজ রয়েছে। যারা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এখন যে গণহত্যা চলছে, তা আর পরোক্ষ নয়; এটি সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে। প্রতিটি বসতি, প্রতিটি বসতি স্থাপনকারী, এবং বিচারবহির্ভূতভাবে আটক প্রতিটি বন্দি- এই সকলই যুদ্ধাপরাধের আওতায় পড়ে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি থাকা অবস্থায় এই সত্যগুলো আরো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে।

নেতানিয়াহুর জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক বাস্তবতা হলো- তিনি এতবার ‘ভিকটিম কর্ড’ খেলেছেন যে সেটি এখন আর কার্যকর নয়। তার কথায় কেউ বিশ্বাস করছে না। আর আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে চলমান গণহত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হলে, ইতিহাসের কাঠগড়ায় তার এবং তার রাষ্ট্রের জবাবদিহি অবশ্যম্ভাবী।

সূত্র : মিডল ইস্ট মনিটর

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top