(২২ সেপ্টম্বর ২০০১ সালে আমেরিকান সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত ভয়েস অফ আমেরিকা মোল্লা উ-ম-রের এই ইন্টারভিউ রেকর্ড করেছে। টেপ রেকর্ড টাইম বারো মিনিট। ২৬ সেপ্টম্বর ২০০১ সালে দ্য গার্ডিয়ান তা পাবলিশ করেছে। অনুবাদ করেছেন: শারাফাত শরীফ )
ভয়েস অফ আমেরিকা : আপনি কেনো উ-সা-মা বিন লা-দে-নকে (আফগান থেকে) বের করে দিচ্ছেন না?
মোল্লা ওমর রাহিমাহুল্লাহ : এটা কেবল উ-সা-মা বিন লা-দে-ন কেন্দ্রিক ইস্যু নয়; এই বিষয়টা ইসলামের ধর্মীয় আত্মসম্মানবোধের সাথে জড়িত। এতে ইসলামের আত্মসম্মানবোধ ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। একইভাবে আফগানিস্তানের ঐতিহ্য-সংস্কৃতিও ঝুঁকির সম্মুখীন হবে।
ভিওএ : আপনি কি জানেন, আমেরিকা ‘ওয়ার অন টেরর’ শিরোনামে গণহত্যার ঘোষণা দিয়েছে?
মোল্লা ওমর রাহিমাহুল্লাহ : এই ক্ষেত্রে আমি দুটো নিশ্চয়তা দেখতে পাচ্ছি; প্রথমত: আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা, দ্বিতীয়ত: আমিরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা।
আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা হলো, আমার জমিন (আল্লাহর জমিন) সুবিশাল।(১) যদি তুমি আল্লাহর পথে সংগ্রাম করার সংকল্প করে নাও; পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে নিরাপদে বসবাস করতে সক্ষম হবে।
আর জর্জ বুশের পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা হলো, পৃথিবীর যেই প্রান্তেই তুমি লুকিয়ে থাকো; আমি তোমাকে খুঁজে বের করে ফেলবো।
আমরা এখন অপেক্ষায় থাকবো; দেখবো, কার নিশ্চয়তা সফলতার মুখ দেখে।
ভিওএ : আপনি কি আপনার লোকদের ক্ষয়-ক্ষতির ভয় পান না; অন্তত স্বীয় প্রাণনাশের ভয় কি নেই? আপনার প্রতিষ্ঠিত তা-লি-বা-ন কিংবা আপনার দেশের জন্যও আশঙ্কাগ্রস্ত নন?
মোল্লা ওমর রাহিমাহুল্লাহ : যারা সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তাঁর নিকট আত্মসমার্পণ করেছে তাদেরকে তিনি সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কাফেরদের পার্থিব উপার্জনে আমি কখনোই সন্তুষ্ট হবো না।’
আমেরিকা অনেক শক্তিশালী; এমনকি আমাদের চেয়েও দ্বিগুণ বা বলতে হয়─ এরচেয়েও বেশী। তবুও আমেরিকা আমাদের পরাজিত করার মতো শক্তিশালী নয়। কারণ, আমরা এই বিষয়ে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী যে, যদি আল্লাহ তায়ালা আমাদের সাথে থাকেন; কেউ আমাদের পরাজিত করতে সক্ষম হবে না।
ভিওএ : আপনি আমাদের বলছেন, আপনি-আপনারা উদ্বিগ্ন নন; অথচ সারাবিশ্ব আজ আফগানদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে আছে!
মোল্লা ওমর রাহিমাহুল্লাহ : হ্যা, আমরা কিঞ্চিৎ চিন্তিত; আমাদের সামনে বড় সংকট রয়েছে; কিন্তু আমরা কেবল আল্লাহর অনুগ্রহের ভিখারী।
আমাদের ভাবনার দৃষ্টিকোণটা বিবেচনা করে দেখুন; যদি আজ আমরা উসামাকে দূরে ঠেলে দেই, নামধারী মুসলিম যারা আজ উ-সা-মাকে আস্তকুঁড়ে নিক্ষেপের জন্য আমাদের দরবারে কড়া নাড়ছে; একদিন তারাই উ-সা-মা-কে দূরে ঠেলে দেওয়ার কারণে আমাদের ঘৃণা করতে শুরু করবে।
আজ বিশ্বের সকল দেশ আমেরিকার ভয়ে ভীত হয়ে আছে; সবাই কেবল আমেরিকাকে খুশি করতে, খুশি রাখতে চায়। কিন্তু যে ঘূর্ণিঝড়ের সবে সূচনা হয়েছে; আমেরিকান জনগণ তা কস্মিনকালেও রোধ করতে সক্ষম হবে না। কারণ, আমেরিকা ইসলাম ধর্মকে জিম্মি করে নিয়েছে।
যদি আপনি ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোর প্রতি লক্ষ্য করেন, আপনি দেখবেন; তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তারা ইসলাম হারিয়ে যাওয়ার গুঞ্জন তুলছে। যদিও আত্মবিশ্বাসী মুসলিমরা নিশ্চিতভাবেই তাদের বিশ্বাস মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। অবশিষ্টরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে; তাদের অনেকে বিষাদ বেদনায় আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে; তারা মনে করছে, হারানোর মতো আমাদের তো আর কিছুই নেই!
ভিওএ : ‘আমেরিকা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে জিম্মি করে রেখেছে;’ আপনার এই বক্তব্যের অর্থ কি?
মোল্লা ওমর রাহিমাহুল্লাহ : আমেরিকা মুসলিম রাষ্ট্রযন্ত্রকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করছে। মুসলিম নাগরিকরা সরকারকে ইসলাম ধর্ম অনুসরণের জন্য চাপ প্রয়োগ করছে; কিন্তু সরকার আমেরিকার চকচকে দুনিয়ার ঘোরে অন্ধ হয়ে বসে আছে।
কেউ ইসলামের সঠিক পথে কদম বাড়ালে সরকার তাকে গ্রেফতার করছে, নির্যাতন করছে এবং গুম-খুন করে লুকিয়ে ফেলছে। পর্দার আড়ালে এই কাজটা মূলত আমেরিকার করছে। আমেরিকা যদি স্বৈরাচারী এই সকল সরকারকে সাহায্য করা ছেড়ে দেয়; সাধারণ মানুষের হাতে তাদের ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ দেয়; তাহলে এমন শিকলবন্দী, নির্যাতন আর আড়ালে, লুকিয়ে-ছাপিয়ে খুন-গুম কখনোই সম্ভব হবে না।
আমেরিকা এমন এক পিশাচ তৈরী করেছে; যা একে একে সবাইকে ধ্বংসের ধারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। যদি আমি মৃত্যুবরণ করি, যদি উসামা মৃত্যুবরণ কিংবা অন্যরা সবাই ─যারা পিশাচের নাগপাশ থেকে জনগণকে মুক্ত করতে চায়─ মৃত্যুবরণ করে; তাহলে এই পিশাচকে কখনোই রোধ করা সম্ভবপর হবে না।
আমেরিকার উচিত এক কদম পিছে হটা, নিজেদের কুটনীতি, পররাষ্ট্রনীতি পর্যালোচনা করা। এতে হয়তো নিজেদের সম্রাজ্যনীতি পুরো বিশ্বের উপর চাপিয়ে দেওয়া থেকে তারা বিরত হবে; বিশেষত মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে।
ভিওএ : তাহলে আপনি ভাবছেন, কখনোই উ-সা-মা-কে হস্তান্তর করবেন না?
মোল্লা ওমর রাহিমাহুল্লাহ : অবশ্যই না; আমরা এমনটা কখনোই করবো না। এমন ঘৃণিত কর্মের অর্থ দাঁড়ায়, আমরা মুসলিম-ই নই, এর অর্থ দাঁড়ায় ইসলামের ভ্রাতৃত্ববোধের কবর রচিত হয়ে গেছে।
যদি আমরা জনগণের গণহত্যার বিষয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হতাম; তাহলে আমরা শেষবার (সোভিয়তের সময়) উসামাকে নিরাপত্তার ঢাল বানাতাম; যখন আমাদেরকে গণহত্যার ভয় দেখানো হয়েছিল; এবং তা সংঘটিতও হয়েছিল। সো এ্যামেরিকা ক্যান হিট আস এগেইন! যদিও এইবার আমাদের কোনো বন্ধুও নেই! (সোভিয়ত ইউনিয়নের আক্রমণকালে আমেরিকা স্বীয় স্বার্থরক্ষার্থে আফগানদের সর্বাত্তক সাহায্য করেছিল।)
ভিওএ : যদি আপনি সর্বশক্তি দিয়ে আমেরিকার সাথে যুদ্ধ করেন; যদিও তালেবান তা করতে সক্ষম হবে কিনা─ এই প্রশ্ন থেকেই যায়। এরপরও আমেরিকা কি আপনাকে পরাজিত করতে সক্ষম হবে না? আর আপনার জনগণ কি আগের বারের চেয়েও বেশি ধ্বংসের স্বীকার হবে না?
মোল্লা ওমর রাহিমাহুল্লাহ : আমি এই বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী; অথবা দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পারি; এমনটাও নাও তো ঘটতে পারে। অনুগ্রহপূর্বক এই পয়েন্টি মার্ক করে রাখুন, ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর অনুগ্রহের উপর নির্ভর করা ছাড়া আমাদের বেশি কিছু করার থাকবে না। যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহর অনুগ্রহের প্রার্থনা করে; তাহলে তিনি (বিশ্বাসীদের) নিশ্চয়তা দিয়েছেন; তিনি তাকে সাহায্য করবেন, তাঁর প্রতি অনুকম্পার দৃষ্টি দিবেন; এবং নিঃসন্দেহে সে সফলকাম হবে।’
(আল্লাহ তায়ালা তালিবানকে স্বীয় রাষ্ট্রে অবৈধ দখলদারদেরকে উৎখাতের তাওফিক দিন। তা-লি-বা-ন ও আ-ল-কা-য়-দা-র শহীদদের প্রতি রহম করুন। আমিন।)
টিকা:
(১) মোল্লা উমর রাহিমাহুল্লাহ কেরআন মাজিদের একটি আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তা হলো: ‘আল্লাহর যমীন কি এমন প্রশস্ত ছিল না যেখানে তোমরা হিজরত করতে?’ (সূরা, নিসা: ৪:৯৭)