সম্পাদকীয় ডেস্ক
‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি নিয়ে জাতীয় সংগীত হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলছে। সমালোচকেরা বলেন, এই গানটিতে বাংলাদেশের জন্ম, ভাষা আন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের কোনো প্রত্যক্ষ বা প্রতীকী উপস্থিতি নেই। একটি রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত তার স্বাধীনতার সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও রাজনৈতিক চেতনার প্রতিফলন হওয়া উচিত। অথচ এই গানটির মূল পটভূমি ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময়, যা ব্রিটিশ ভারতের অভ্যন্তরীণ একটি সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়া। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের জন্য এ গানটির প্রেক্ষাপটকে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক মনে করা হয়।
এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ভারতের নাগরিক এবং ১৯৪১ সালে মৃত্যুবরণ করেন—যার অর্থ তিনি ১৯৪৭ সালের উপমহাদেশের বিভাজন বা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ, কোনো ঘটনাই প্রত্যক্ষ করেননি। ফলে তাঁর রচিত একটি গানকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে বহাল রাখার মধ্যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দুরভিসন্ধি রয়েছে। সমালোচকেরা একে ভারতের প্রভাব বিস্তারের একটি নরম সংস্কৃতিগত কৌশল হিসেবে দেখেন।
আরও বড় প্রশ্ন হচ্ছে, এই গানটি মূলত ঔপনিবেশিক সময়ের অভিজাত বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। এটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের বাস্তব জীবন, ভাষা, সংগ্রাম ও আত্মপরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এই সাংস্কৃতিক বৈসাদৃশ্য শুধু ইতিহাসের বিকৃতি নয়, বরং একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক নির্মাণে অন্তর্ঘাত বলেই মনে করা হয়। এটি নিছক একটি কাব্যিক গান নয়, বরং ভারতীয় আধিপত্যবাদী চেতনার প্রতিনিধিত্বকারী প্রতীক হিসেবে বহু বিশ্লেষকের চোখে প্রতিভাত হয়েছে।
জাতীয় সংগীত নির্ধারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত জনগণের মতামত ছাড়াই গৃহীত হয়েছে—এ বিষয়টি গণতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্পষ্টতই প্রশ্নবিদ্ধ। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক সিদ্ধান্তে গণভোট বা গণআলোচনার আয়োজন না করায় রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, যা সহজে অতিক্রমযোগ্য নয়।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, একটি ভুল প্রতীকের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে বিকৃত ইতিহাস, বিভ্রান্ত সাংস্কৃতিক বোধ এবং আত্মপরিচয়ের সংকট জন্ম নিচ্ছে। তরুণেরা যে গানটির মধ্য দিয়ে দেশের অস্তিত্বকে অনুভব করবে, সেটি যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আত্মত্যাগ ও বাংলাদেশের নিজস্ব অভ্যুদয়ের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে, তাহলে রাষ্ট্রীয় পরিচয় একধরনের সাংস্কৃতিক বিভ্রমে রূপ নেবে। ফলে এই গানটি রাষ্ট্রীয় প্রতীকের আসন থেকে অপসারণের দাবি শুধু যৌক্তিক নয়, এটি একান্ত জরুরি একটি ঐতিহাসিক সংশোধন।
জাতীয় সংগীত কেন পরিবর্তন দরকার