এ সাঈদ
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জাতিগত ও রাজনৈতিক সংকটপুঞ্জে রোহিঙ্গা সমস্যাকে আজ বিশ্বের অন্যতম মানবিক বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। নাগরিকত্বহীনতা, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, এবং জেনোসাইড—এই তিন স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে রাখাইনের মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দীর্ঘ দুর্দশা। এই সংকটের ছায়ায় জন্ম নেওয়া একটি প্রতিরোধ সংগঠন হলো আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা (ARSA)। মিয়ানমারের সামরিক সরকার যাকে “সন্ত্রাসী” ঘোষণা করেছে, সেই সংগঠনটিই আসলে কী? সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী, না কি নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি সীমিত প্রতিরোধ?
এই প্রতিবেদনটি আরসার বিকল্প পাঠ উপস্থাপন করছে—যেখানে তারা অস্ত্র তুলে নিয়েছে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে, কোনো আদর্শিক বা আক্রমণাত্মক উদ্দেশ্যে নয়।
আরসার উদ্ভব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর পেছনে রয়েছে বহু দশকের রাষ্ট্রীয় বঞ্চনা ও নির্মম নিপীড়ন। ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে মিয়ানমার সরকার যখন তাদের রাষ্ট্রহীন করে তোলে, তখন থেকেই এই জনগোষ্ঠী একটি ন্যায্য অস্তিত্বের জন্য লড়াই করছে। রাষ্ট্রীয় শিক্ষা, চিকিৎসা, চলাফেরার অধিকার—সবকিছু থেকেই তারা ছিল বঞ্চিত। ২০১৬–২০১৭ সালে যখন সেনাবাহিনীর পরিচালিত গণহত্যা বিশ্ববিবেককে কাঁপিয়ে তোলে, তখনই আত্মপ্রকাশ করে ARSA, নিজেদের “নিরাপত্তার বাহিনী” হিসেবে পরিচয় দিয়ে। তাদের প্রাথমিক বিবৃতিতেই উল্লেখ ছিল, তারা বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে নয়, বরং সেই রাষ্ট্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যাঁরা রোহিঙ্গা নিধনে জড়িত।
ARSA একাধিকবার প্রকাশ্য বিবৃতিতে জানিয়েছে যে তাদের সঙ্গে কোনো আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের যোগাযোগ নেই, বরং তারা একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য সক্রিয়। ২০১৭ সালে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়: “আমরা সন্ত্রাসী নই। আমরা শুধু আমাদের জাতিকে সম্মানের সঙ্গে, নিরাপদে বাঁচানোর চেষ্টা করছি, তাদের জন্মভূমিতে।” তাদের দাবি—যদি রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার স্বীকৃতি পায়, তবে আর অস্ত্র ধরার প্রয়োজনই থাকবে না।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো যেমন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বারবার বলেছে—রোহিঙ্গা নিধনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল ভয়াবহ, পরিকল্পিত, এবং আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। যদিও কয়েকটি প্রতিবেদনে ARSA’র বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হামলার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তবে সেসব ক্ষেত্রেই প্রেক্ষাপট হিসেবে রাষ্ট্রীয় বর্বরতার বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এশিয়া পলিসি জার্নালে প্রকাশিত বিশ্লেষক অনসোলো ফার্নান্দেজের এক গবেষণায় বলা হয়, “ARSA হচ্ছে একটি আত্মরক্ষামূলক প্রতিরোধ গোষ্ঠী, যাদের আচরণ ধর্মীয় চরমপন্থা বা অঞ্চল দখলের চেয়ে বেশি আত্মসুরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়ার মতো।”
ARSA এর বার্তাগুলোতে সহিংসতার চেয়ে রাজনৈতিক সমাধানের প্রতি আগ্রহ স্পষ্ট। বারবার তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আলোচনায় বসার জন্য। তারা রোহিঙ্গা জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি, নিরাপত্তা, ও নাগরিক অধিকার দাবি করে আসছে, অস্ত্র নয়। তাদের একাধিক বিবৃতিতে বৌদ্ধ বেসামরিক নাগরিকদের প্রতি সহাবস্থানের বার্তা রয়েছে। ARSA কোনো সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় উৎসাহী নয়, বরং তা নিরুৎসাহিত করতে চায়।
আধুনিক বিশ্বে “সন্ত্রাসবাদ” শব্দটির সংজ্ঞা যত না আইনি, তার চেয়েও বেশি রাজনৈতিক। বারবার দেখা গেছে—যে জাতিগুলো রাষ্ট্রীয় সহিংসতার শিকার, তাদের প্রতিরোধকেই “সন্ত্রাস” হিসেবে চিত্রিত করা হয়। ফিলিস্তিন, কাশ্মীর কিংবা মিয়ানমার—প্রতিটি অঞ্চলে এই প্রবণতা লক্ষণীয়। ARSA-কে “সন্ত্রাসী” হিসেবে চিহ্নিত করা হলে সেই রাজনীতিরই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এই সংগঠন জন্ম নিয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর আত্মরক্ষার জন্য—যাদের পক্ষে না দাঁড়ানো মানে মানবতার বিপক্ষে দাঁড়ানো।
রোহিঙ্গা সংকট আমাদের সময়ের এক ভয়াবহ মানবিক ব্যর্থতা। আরসা যদি সেই ব্যর্থতার প্রতিক্রিয়ায় অস্ত্র ধরে থাকে, তাহলে প্রশ্ন হওয়া উচিত—তারা কেন বাধ্য হলো? যদি বিশ্ব সমাজ রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে কি তারা নিজেরা নিজেদের রক্ষা করার অধিকারও হারায়?
আজ প্রয়োজন সততা ও সংবেদনশীলতা—সন্ত্রাস বা ন্যায্য প্রতিরোধের প্রশ্নে নয়, বরং এক জাতির অস্তিত্বের প্রশ্নে। আরসার কর্মকাণ্ডকে বোঝার আগে তাদের অস্তিত্বের কারণগুলো বুঝতে হবে।
তথ্যসূত্র:
– ARSA’র আনুষ্ঠানিক বিবৃতি (২০১৬–২০১৮)
– জাতিসংঘের মিয়ানমার সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন (২০১৮)
– হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্ট (২০১৭–২০১৯)
– আল-জাজিরা সাক্ষাৎকার (২০১৭)
– এশিয়া পলিসি জার্নাল: “Insurgency or Survival?” — অনসোলো ফার্নান্দেজ (২০১৯)
– UNHCR ডকুমেন্টেশন: রোহিঙ্গা রাষ্ট্রহীনতা




