সম্পাদকীয় ডেস্ক
একটি সংগঠন, যাদের বিরুদ্ধে ইতিহাস বিকৃতি, গণতন্ত্র হরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রক্তাক্ত দমন-পীড়নের মতো ভয়াবহ অভিযোগ রয়েছে, তারা কি আর আদৌ এদেশে ‘রাজনৈতিক দল’ হিসেবে টিকে থাকার নৈতিকতা বা বৈধতা রাখে?
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসকে দলীয়করণ ও পারিবারিকীকরণের অভিযোগ বহুবার উঠেছে। বিশেষত, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসকে একচেটিয়াভাবে নিজের দখলে রাখার চেষ্টা, রাজনৈতিক বৈচিত্র্যকে দমন করে একদলীয় বর্ণনায় রূপান্তর করা এবং বিরুদ্ধ মতকে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় মুছে ফেলার অপচেষ্টা—এসব আজ আর আড়ালে নেই।
জনগণের ভোটাধিকার যখন বারবার খর্ব হয়েছে, নির্বাচন ব্যবস্থা যখন পরিকল্পিতভাবে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, তখন রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের কাছ থেকে সরে গিয়ে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে চলে গেছে। এর চেয়েও বেশি উদ্বেগজনক বিষয় হলো—জনসমর্থনের বদলে যখন একটি দল দেশের ভৌগোলিক নিরাপত্তা ও নীতিনির্ধারণে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উপর নির্ভর করে, তখন তা আর শুধু রাজনৈতিক কৌশল নয়—বরং রাষ্ট্রীয় স্বার্থের ঘোরতর অবমাননা।
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দমন-পীড়নের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে বিভিন্ন নিরপেক্ষ মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবেদনে। বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী এমনকি সাধারণ নাগরিকদেরও গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নজরদারি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মতো ঘটনা এই সময়কালের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এসব ঘটনার দায়ভার থেকে কেউই নিজেকে মুক্ত করতে পারে না।
শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দলীয়করণ—এসব মিলে গোটা দেশকে এক অদৃশ্য শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে তোলা হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। শাপলা চত্বরের মতো ঘটনায় শিশু ও আলেমদের বিরুদ্ধে চালানো সামরিক অভিযান এবং সম্প্রতি আলোচিত ‘জুলাই গণহত্যা’ এই চিত্রকে আরো ভয়াবহভাবে স্পষ্ট করে।
এইসব ঘটনার বিপরীতে এখনো পর্যন্ত দলটির কোনো শীর্ষ নেতা ন্যূনতম অনুশোচনা, আত্মসমালোচনা কিংবা ক্ষমা প্রার্থনার ভাষাও উচ্চারণ করেননি। বরং ঘটনার ভয়াবহতা আড়াল করতে বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও অজুহাত তুলে ধরে গণহত্যার ন্যায় অন্যায় কাজকে রাজনৈতিক বৈধতা দেওয়ার প্রচেষ্টা চলেছে। এতে স্পষ্ট যে, শুধরানোর প্রবণতা নয়, বরং ক্ষমতা রক্ষার কৌশলই তাদের প্রধান লক্ষ্য।
এই প্রেক্ষাপটে দেশবাসীর সামনে এখন এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হাজির হয়েছে—বাংলাদেশের রাজনীতি কি এমন একটি দলে আর জায়গা দিতে পারে, যাদের হাতে ইতিহাস, গণতন্ত্র, নৈতিকতা ও মানবাধিকারের এই নির্মম পরিণতি ঘটেছে?
প্রশ্নটি সহজ, উত্তরটি আরও সহজ। রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রের জন্য কাজ করে; রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়। যখন কোনো সংগঠন একের পর এক অপরাধমূলক কর্মকা-কে ‘রাজনীতি’ নামে চালিয়ে দিতে চায়, তখন সেটি আর রাজনৈতিক সংগঠন থাকে না—তা পরিণত হয় এক ভয়ঙ্কর নিয়ন্ত্রক শক্তিতে, যা গণতন্ত্র নয়, দমনকে প্রতিষ্ঠা করে।
এতসব ঘটনার পরেও যদি এমন একটি সংগঠনকে আবার রাজনীতির মূলধারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হয়, তবে তা কেবল শহিদদের আত্মত্যাগকেই অবমূল্যায়ন করবে না, বরং আজ যারা দেশের পরিবর্তনের জন্য জীবন বাজি রেখে দাঁড়িয়েছে—তাদের অস্তিত্বকেও বিপন্ন করে তুলবে।
সুতরাং, এখন সময় এসেছে—দেশবাসী ভেবে দেখবে, একটি সন্ত্রাসী রূপে অভিযুক্ত ও নৈতিকভাবে দেউলিয়া সংগঠন কি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘আওয়ামী লীগ’ নামে আর টিকে থাকার অধিকার রাখে?