আশুরা, হোসাইন রা:

আশুরা : ইতিহাসের সত্য আর আজকের ভ্রান্ত অনুশীলন

‎হোসাইন আদনান

‎মহররম মাসের দশ তারিখ আশুরা। ইসলামের ইতিহাসে এই দিনটির রয়েছে অনন্য মর্যাদা। রাসূলুল্লাহ সা: নিজে আশুরার রোজা রাখতেন এবং সাহাবাদেরও তা রাখার জন্য উৎসাহিত করতেন। একইসাথে ইসলামের ইতিহাসে এ দিনটি জড়িয়ে আছে কারবালার ঘটনার সাথে, যেখানে রাসূল সা:-এর প্রিয় নাতি ইমাম হোসাইন রা: এবং তাঁর পরিবারবর্গ অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শহীদ হন।

কিন্তু আজকের সমাজে আশুরা মানেই যেন শোক, মাতম, তাজিয়া, বুক চাপড়ানো, এমনকি রক্তাক্ত করার মতো কর্মকাণ্ড। আশুরাকে ঘিরে চলে লোকজ সংস্কৃতির সাথে ধর্মের মিশ্রণ। এই প্রথাগুলো শরীয়াহ সম্মত কিনা, তা অনেকেই ভেবে দেখেন না। এই লেখায় আমরা জানার চেষ্টা করব, আশুরার প্রকৃত ইতিহাস ও তাৎপর্য কী এবং আজকের প্রচলিত অনুশীলনগুলো ইসলামের মূল শিক্ষার সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ।

আশুরার প্রকৃত তাৎপর্য

‎রাসূল সা: যখন মদিনায় হিজরত করেন, তখন দেখতে পান ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখে। তারা বলল, এ দিনে মুসা আ: ও তাঁর অনুসারীরা ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। তাই তারা শুকরিয়াস্বরূপ এই দিনে রোজা রাখে। তখন রাসূল সা: বলেন, ‘আমরা মুসার প্রতি তাদের চেয়েও বেশি হকদার।’ তিনি নিজে রোজা রাখেন এবং সাহাবীদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দেন। পরবর্তী বছর বলেছিলেন, ‘আমি বেঁচে থাকলে ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ তারিখ রোজা রাখব।’

‎এ থেকে স্পষ্ট হয়, আশুরার গুরুত্ব ইসলামে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও অতীতের নবীদের বিজয় স্মরণে। এটি কখনোই কান্না বা শোকের দিন নয়।

কারবালার ঘটনা ও ইমাম হোসাইন রা:-এর ত্যাগ

‎৬১ হিজরির ১০ মহররম ইতিহাসের একটি বেদনাবিধুর দিন। এদিন কারবালার প্রান্তরে ইয়াজিদের সৈন্যদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন রাসূল সা:-এর প্রিয় নাতি ইমাম হোসাইন রা:। তিনি সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে ছিলেন এবং ফিতনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর অবস্থান ছিল স্পষ্ট। তিনি অন্যায়ের সামনে মাথা নত করেননি। ইমাম হোসাইন রা: বলেছিলেন, ‘আমি সত্য প্রতিষ্ঠা করতে এবং মুমিনদের সমাজকে সংশোধন করতে চাই।’ এই লক্ষ্যেই তিনি জীবন বিসর্জন দেন। কিভাবে একজন প্রকৃত মুসলমান অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হয়, তাঁর এই আত্মত্যাগে ওই আদর্শ আছে।

আশুরাকে ঘিরে বিদআত ও শরীয়তবিরোধী কিছু প্রচলন

‎দুঃখজনকভাবে আশুরাকে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজে কিছু প্রথা চালু হয়েছে, যা শরীয়তবিরোধী, ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে বিচ্যুত এবং কখনো কখনো শিরক ও কুফরির কাছাকাছি।

‎১. বুক চাপড়ানো ও শরীরে আঘাত করা

‎আশুরার দিন অনেক মানুষ নিজেদের বুক চাপড়ায়, মাথায় বা শরীরে আঘাত করে রক্ত ঝরায়। এর পেছনে ভাবনা হলো, ইমাম হোসাইন রা:-এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ। কিন্তু ইসলাম আত্ম-আঘাত বা রক্ত ঝরানোর অনুমতি দেয়নি। বরং রাসূল সা: বলেছেন, ‘সে আমাদের দলভুক্ত নয়, যে গালে আঘাত করে, কাপড় ছিঁড়ে এবং জাহিলিয়াতের মতো আহাজারি করে।’ এসব আচরণ কেবল নিজের শরীরকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না। বরং ইসলামী আদর্শেরও অবমাননা করে।

‎২. তাজিয়া মিছিল ও নাটক মঞ্চস্থকরণ

‎আশুরার দিনে অনেক জায়গায় ‘তাজিয়া’ নামে কাঠের বা মাটির তৈরি কাঠামো বানিয়ে মিছিল করা হয়। অনেকে কারবালার ঘটনাকে নাটক বা ‘ড্রামা’র মাধ্যমে তুলে ধরে। এসব কিছুই ইসলামের মধ্যে বিদআত হিসেবে বিবেচিত।
‎ইসলামে কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনা কল্পনাপ্রসূত নাটকীয় উপায়ে উপস্থাপন করার অনুমতি নেই। ইমাম হোসাইনের আত্মত্যাগকে যদি হাস্যকর বা নাট্যরূপে পরিবেশন করা হয়, তা তাঁর আদর্শের বিরুদ্ধেই যায়।

‎৩. কবরকেন্দ্রিক আচরণ

‎আশুরা উপলক্ষে কবরস্থানে তাজিয়া নিয়ে যাওয়া, মোমবাতি জ্বালানো, কবর ছুঁয়ে মানত করা। এসব আচরণ সরাসরি শিরক ও বিদআতের মধ্যে পড়ে। ইসলাম কবর পূজাকে নিষিদ্ধ করেছে। রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমরা আমার কবরকে ইবাদতের স্থান বানিয়ো না।’ অথচ আজ অনেক মানুষ আশুরা উপলক্ষে কবরকেন্দ্রিক যে আচরণগুলো করে থাকে, তা পুরোপুরি শরীয়তবিরোধী।

‎৪. গান, বাদ্যযন্ত্র, মাতম ও অতিরঞ্জিত শোক

‎কিছু এলাকায় আশুরার নামে আয়োজন করা হয় শোকসভা, যেখানে বাজানো হয় দুঃখী গান, ব্যবহার করা হয় বাদ্যযন্ত্র, অনেক সময় নারীরা পুরুষদের সাথে মিশে মাতম করে থাকে। এসব কোনোভাবেই ইসলাম অনুমোদন করে না। রাসূল সা: জীবদ্দশায় কারো মৃত্যুর পর এভাবে প্রকাশ্যে শোক পালন করার অনুমতি দেননি। ‎‎শোক প্রকাশ করা স্বাভাবিক, তবে তা সীমার মধ্যে ও শরীয়তসম্মত পদ্ধতিতে হতে হবে। নাটক, সুর, গান, কল্পকাহিনি দিয়ে আশুরা পালন করলে প্রকৃত শিক্ষা বিলীন হয়ে যায়।

‎আশুরার প্রকৃত শিক্ষা কী হওয়া উচিত?

‎ইমাম হোসাইন রা: আমাদের শিখিয়ে গেছেন সত্য ও ন্যায়ের জন্য আত্মত্যাগ কেমন হওয়া উচিত। তিনি মৃত্যুকে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি। তাঁর জীবনের মূল বার্তা-
-‎সত্যের জন্য দৃঢ় থাকো।
‎-অন্যায়ের সামনে কখনো নত হয়ো না।
‎-‎নৈতিকতা, সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের মানসিকতা ধারণ করো।

‎‎আজকের মুসলিম উম্মাহ যদি আশুরার প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করতো, তাহলে হয়তো অনেক জায়গায় অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে উঠত। আশুরা হলো সঠিক নেতৃত্ব, আত্মত্যাগ ও আখেরাতভিত্তিক জীবনদর্শনের প্রতীক।

আশুরায় আমাদের ‎করণীয়

‎১. রাসূল সা:-এর সুন্নত অনুযায়ী আশুরার রোজা রাখা (৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ মহররম)।
‎২. বিদআত ও শরীয়তবিরোধী প্রথাগুলো থেকে দূরে থাকা।
‎৩. কারবালার আত্মত্যাগ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা।
‎৪. নিজেকে শুদ্ধ করার চেষ্টা করা—ইবাদত, তাওবা ও দোয়ার মাধ্যমে।
‎৫. সমাজে আশুরা সম্পর্কিত ভ্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধে তথ্যভিত্তিক আলোচনা ছড়িয়ে দেয়া।

আসুন, আমরা আশুরাকে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে পালন করি। বিদআত ও শিরক থেকে দূরে থেকে শরীয়তসম্মত উপায়ে দিনটিকে কাটাই। আত্মশুদ্ধির সুযোগ হিসেবে আশুরাকে গ্রহণ করি এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে দৃঢ় থাকি। তবেই ইমাম হোসাইন রা:-এর আত্মত্যাগের প্রতি হবে প্রকৃত শ্রদ্ধা।

লেখক : আলেম ও শিক্ষাবিদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top