টুডেনিউজ বিডি ডটনেট
সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে সিরিয়ায় হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে রাশিয়া। শুক্রবার (১৯ মার্চ) মিডল ইস্ট মনিটরের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিরিয়ায় নেতৃত্ব পরিবর্তনের পর নতুন সরকারের সাথে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণের উদ্দেশ্যে আলোচনার মধ্যেই রাশিয়া জানিয়েছে, তারা সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে হস্তান্তর করবে না।
সিরিয়ায় তুরস্কের উপস্থিতি, কেন ভয় পাচ্ছে ইসরাইল
৮ ডিসেম্বর বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সিরিয়াকে দ্রুত নিয়ন্ত্রণে নেয়ার মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে দেশটির দীর্ঘদিনের স্বৈরাচারী শাসনের। এরপর সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ রাশিয়ায় পালিয়ে যান। গৃহযুদ্ধকালীন দীর্ঘকালীন মিত্র মস্কো তাকে ও তার পরিবারকে আশ্রয় দেয়।
এরপর থেকে সিরিয়ার নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং এর প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা একাধিকবার রাশিয়াকে আহ্বান জানিয়েছেন, যেন আসাদকে সিরিয়ার জনগণের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের বিচারের জন্য তাকে হস্তান্তর করা হয়। এর পরই আসাদকে সিরিয়ায় হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে রাশিয়া।
সিরিয়ার প্রতিবিপ্লব যেভাবে ব্যর্থ করা হয়
অবশ্য এই অনুরোধ মস্কো ও দামেস্কের মধ্যে চলমান আলোচনার একটি অংশ। এর উদ্দেশ্য ছিল অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা চুক্তি ও সামরিক সরঞ্জামের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সমাধান করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পুনর্নির্মাণ করা।
আসাদকে সিরিয়ায় হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি কেন
ইরানের ইসলামিক রিপাবলিক নিউজ এজেন্সি (ইরনা)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরাকে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলপেরাস কোত্রাশেভ বলেছেন, ‘মস্কোতে বাশার আল-আসাদের বসবাসের শর্ত ছিল তিনি কোনো মিডিয়া বা রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশ নেবেন না। এখন পর্যন্ত তিনি তা লঙ্ঘন করেননি। সেজন্য আসাদকে সিরিয়ায় হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে রাশিয়া।’
রাশিয়ান কূটনীতিক আরো জানান, ‘রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সরাসরি নির্দেশে বাশার আল-আসাদ ও তার পরিবারকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই।’
উল্লেখ্য, দীর্ঘ প্রায় দুই দশকের শাসনের অবসান ঘটিয়ে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ পরিবারসহ মস্কোয় আশ্রয় নিয়েছেন। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থাগুলোর বরাতে জানা গেছে, তাকে মানবিক কারণে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একটি যুগান্তকারী মোড় তৈরি করেছে।
রুশ সংবাদ সংস্থা তাস এবং আরআইএ জানায়, ক্রেমলিনের এক অজ্ঞাত সূত্র নিশ্চিত করেছে আসাদের আগমন। যদিও অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস স্বাধীনভাবে তথ্যটি যাচাই করতে পারেনি, তারা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট দপ্তরের মন্তব্যের অপেক্ষায় রয়েছে। একইসাথে, সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটি ও কূটনৈতিক স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছে বিদ্রোহীরা, এমনটিও জানানো হয়।
দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে আসাদের পরিবার দেশ শাসন করলেও, হঠাৎ করেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। কয়েক দিনের ব্যবধানে বিদ্রোহীরা আলেপ্পো, হামা ও হোমস শহরগুলো দখল করে নেয়। সিরিয়ার সেনাবাহিনী বড় কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। রাজধানী দামেস্কে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, বন্দুক ছুড়ে উৎখাত উদযাপন করে।
এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিচ্ছে হায়াত তাহরির আল-শাম (HTS), যার উৎস আল-কায়দায়। সংগঠনটির নেতৃত্বে রয়েছে আবু মোহম্মদ আল-জোলানি, যিনি দাবি করছেন যে তিনি এখন ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও বহুত্ববাদে বিশ্বাসী। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ HTS-কে এখনো সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে।
আসাদের প্রধান মিত্র রাশিয়া জানিয়েছে, বিদ্রোহীদের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে তিনি দেশ ত্যাগ করেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এর মাধ্যমে রাশিয়া একটি রক্তপাতহীন সমাধান নিশ্চিত করতে চেয়েছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
আসাদের পতন শুধু সিরিয়ার জন্য নয়, বরং গোটা অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি ইরান ও হিজবুল্লাহর মতো আসাদপন্থী গোষ্ঠীগুলোর জন্য বড় ধাক্কা। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল-বিরোধী জোটে আসাদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। হিজবুল্লাহ ইতোমধ্যে লেবাননে ইসরাইলের সাথে একটি যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছেছে, তবে গাজায় ইরান-সমর্থিত হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে।
যদিও HTS ক্ষমতার কেন্দ্রস্থলে এসেছে, সিরিয়ায় এখনো জটিল রাজনৈতিক ও সামরিক বিভাজন রয়েছে:
– উত্তরাঞ্চলে তুরস্ক-সমর্থিত বিদ্রোহীদের সাথে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত কুর্দি যোদ্ধাদের সংঘর্ষ চলছে।
– দেশের কিছু অংশে এখনো ইসলামিক স্টেট (IS) সক্রিয়।
বাশার আল-আসাদের আকস্মিক পতন ও তার মস্কোতে আশ্রয় নেওয়া মধ্যপ্রাচ্যের ভৌগোলিক ও কূটনৈতিক বাস্তবতায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। বিদ্রোহীদের অভ্যন্তরীণ ঐক্য, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, এবং দেশের স্থিতিশীলতা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক দখল করার কথা ঘোষণা করেছে বিদ্রোহীরা। এর মাধ্যমে বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন হলো।
প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ বিমানে করে ইতোমধ্যেই রাজধানী ছেড়ে চলে গেছেন বলে জানা গেছে। তার বিদায়ের পরপরই দামেস্ক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরকারি বাহিনী সরে যায়।
সরকারি বাহিনী জানিয়েছে, তাদের সৈন্যরা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ছেড়ে চলে গেছে। আর বিদ্রোহীরা সরকারি টেলিভিশন ও রেডিও স্টেশন দখল করার দাবি করেছে। তারা অন্যান্য স্থাপনার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করছে।
সিরিয়ার বিদ্রোহীরা জানিয়েছে, ‘স্বৈরাচার বাশার আল-আসাদ পালিয়ে গেছেন। আমরা দামেস্ককে স্বৈরাচার বাশার আল-আসাদমুক্ত বলে ঘোষণা করছি।’
এর আগে দাবি করা হয়, পর্যবেক্ষণকারী ইউনিটগুলো রাতেই দামেস্কে প্রবেশ করে। তারা প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সন্ধান করছে। তবে তাকে তারা পায়নি।
শনিবার এক দিনে সিরিয়ার চারটি নগরী দখল করার পর বিদ্রোহীরা রাজধানী দখল করার দিকে মনোযোগ দেয়। দারা, কুনিত্রা, সাওয়াদা ও হোমস শনিবার বিদ্রোহীরা দখল করে।
শনিবার সিরিয়াবিষয়ক জাতিসঙ্ঘ বিশেষ দূত, গেইর পেডারসান ‘সুশৃঙ্খলভাবে রাজনৈতিক পরিবর্তন’ নিশ্চিত করতে জেনেভায় জরুরি বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছেন। কাতারে বার্ষিক দোহা ফোরামে ভাষণ দেয়ার সময়ে তিনি বলেন সিরিয়ার পরিস্থিতি মিনিটে মিনিটে পাল্টাচ্ছে। বাশারের প্রধান আন্তর্জাতিক সমর্থক দেশ রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই লাভরভ বলেন, তিনি ‘সিরিয়ার জনগণের জন্য দুঃখ বোধ করছেন’।
সূত্র : মিডল ইস্ট মনিটর
আসাদ-পরবর্তী সিরিয়া নিয়ে যে কারণে সঙ্ঘাতে জড়াতে পারে তুরস্ক-ইসরাইল