ইমাম একটি শব্দ, যার মধ্যে নিহিত রয়েছে নেতৃত্ব, দায়িত্ব, আস্থা ও দিকনির্দেশনা। শুধু নামাজ পড়িয়ে দেয়া নয়, বরং একটি সমাজকে ধর্মীয়ভাবে জাগ্রত ও সৎপথে পরিচালনার অন্যতম কান্ডারি হলেন ইমাম। তিনি যদি তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন, তবে সমাজ আলোকিত হয়। আর যদি দায়িত্ব থেকে বিমুখ হন, তবে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় পুরো মহল্লা। এই প্রেক্ষিতে একজন ইমামের দায়িত্ব কী এবং ওই দায়িত্ব পালনের জন্য কোন ধরনের যোগ্যতা থাকা দরকার, তা জানা দরকার। আমরা এই প্রবন্ধে ওই বিষয়টিই আলোকপাত করব। ইনশাআল্লাহ।
ইমাম সাহেবের দায়িত্বকে কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ইহতেমামের সাথে জামাআতে পড়ানো তার মূল দায়িত্ব। জামাআতের রূহানিয়াত, নিয়ম-শৃঙ্খলা ও সময়ানুবর্তিতা নিশ্চিত করা তার কর্তব্য।
দ্বিতীয়ত, নামাজের আগে কিংবা পরে কিছু সময় জ্ঞানের আলো ছড়ানো, মানুষের অন্তরে বিশুদ্ধ ঈমান, সহিহ আমল ও উত্তম চরিত্র গঠনের চিন্তা জাগানো তার অপরিহার্য দায়িত্ব।
তৃতীয়ত, মুসল্লিদের শরিয়ার মাসায়েল বোঝানো, ইসলামি বিধানের সৌন্দর্য তুলে ধরা এবং দ্বীনি জিজ্ঞাসার সদুত্তর দেয়া তার প্রয়োজনীয় কার্যক্রম।
চার নম্বর দায়িত্ব হলো মুসল্লিদের পরিবার ও সমাজ জীবনে ইসলামি আদর্শ বাস্তবায়নের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা।
এছাড়া এলাকার নারী-পুরুষ, শিশু-যুবক-প্রবীণ—সকলের ঈমান, আমল ও আখলাকের উন্নয়নে চিন্তাশীল হওয়া একজন ইমামের ফিকিরে থাকা উচিত।
আজকের সমাজে বিভিন্ন ভ্রান্ত মতবাদ, বাতিল দর্শন ও পথভ্রষ্ট ফিরকার আগ্রাসন থেকে মুসল্লিদের হেফাজত করাও একটি বড় দায়িত্ব। পাশাপাশি জাতীয় ও বৈশ্বিক ইস্যুতে মুসল্লিদের বিভ্রান্তি থেকে বাঁচানো, সঠিক অবস্থান জানানো এবং উম্মাহর ঐক্য রক্ষায় দিকনির্দেশনা দেয়াও তাঁর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। সমাজের অন্যায়, দুর্নীতি ও অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সাহসের সাথে অবস্থান নেয়া এবং দ্বীনি প্রশ্ন বা সমস্যার সমাধানে অভিভাবকের মতো ভূমিকা রাখাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি এলাকার নিজস্ব এক বা একাধিক দ্বীনি প্রয়োজন (তাকাযা) থাকে, ইমাম সাহেবকে তা নির্ণয় করে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হয়। সবশেষে, তিনি যেন সবকিছু যাচাই-বাছাই করে, অথেন্টিক কিতাবি দলিল ও বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে দায়িত্বশীল মন্তব্য দেন—এমন যোগ্যতা তাঁর মধ্যে থাকা চাই।
এই বহুমাত্রিক দায়িত্ব পালনের জন্য একজন ইমাম সাহেবকে কেবল ফিকহি জ্ঞান বা কুরআন-হাদীস জানলেই চলবে না। তাকে হতে হবে একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীনি-সামাজিক ব্যক্তিত্ব। তার মধ্যে থাকতে হবে সুদৃঢ় আকীদা, বিশুদ্ধ আমল, পরিশুদ্ধ চরিত্র ও সদাচরণ। ইসলামের মৌলিক বিধান, পারিবারিক ও সামাজিক মাসায়েল, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকা আবশ্যক। দাওয়াতি ভাষায় কথা বলার সক্ষমতা, শ্রোতা অনুযায়ী উপস্থাপন কৌশল, সাংগঠনিক নেতৃত্ব, প্রযুক্তির ব্যবহার জানা, আত্মবিশ্লেষণের মানসিকতা এবং সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা এসব গুণ একজন আদর্শ ইমাম সাহেবকে পরিপূর্ণ করে তোলে।
অতএব, একজন ইমাম কেবল নামাজ পড়ানো ব্যক্তি নন; তিনি একজন দিকনির্দেশক, সমাজ সংস্কারক এবং আত্মিক অভিভাবক। তার হাত ধরেই একটি সমাজ ন্যায়, আদর্শ ও আলোর পথে এগিয়ে যেতে পারে। তাই সমাজের প্রতিটি স্তরকে তার দায়িত্বকে সম্মান করা এবং সংশ্লিষ্ট মহলকে ইমামদের মানোন্নয়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া অত্যন্ত জরুরি। একইসাথে, প্রত্যেক ইমাম সাহেবকেও আত্মউন্নয়ন, জ্ঞানার্জন ও দায়িত্বশীলতার পথে সদা সচেষ্ট থাকতে হবে।
লেখক : পরিচালক, নদওয়াতুল হানাফিয়া বাংলাদেশ