ফোরদো, ইরান, ইসরাইল, পারমাণবিক

ইরানের ফোর্ডো পারমাণবিক কেন্দ্র কেন অভেদ্য দুর্গ?

ইরানের ফোরদো ফুয়েল এনরিচমেন্ট প্ল্যান্ট অত্যন্ত সুরক্ষিত একটি পারমাণবিক স্থাপনা, যা ধ্বংসের সক্ষমতা ইজরায়েলের নাই। এর টেকনিক্যাল ডিটেইলস:

১. পাহাড়ের গভীরে অত্যাধুনিক নির্মাণ:
ফোরদো কেন্দ্রটি কোম শহরের কাছে একটি পাহাড়ের ৮০-৯০ মিটার (২৬০-৩০০ ফুট) গভীরে অবস্থিত। এটি প্রাকৃতিক শিলা ও মাটির পুরু স্তর দ্বারা সুরক্ষিত, যা হাই-এক্সপ্লোসিভ বোমার শক্তি এবসর্ভ করতে সক্ষম। কেন্দ্রটির দেয়াল ও ছাদে মাল্টি-লেয়ার রিইনফোর্সড কংক্রিট ব্যবহৃত হয়েছে, যা ২০০০ পাউন্ডের বোমার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি চাপ সহ্য করতে পারে। এই নকশা এটিকে প্রচলিত প্রিসিশন-গাইডেড মিসাইল থেকে প্রায় অক্ষত রাখে।

২. ইসরায়েলের অস্ত্রের সীমাবদ্ধতা:
ফোরদোর মতো গভীর ও শক্তিশালী স্থাপনা ধ্বংস করতে আমেরিকার GBU-57A/B ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর (MOP) প্রয়োজন। এই ৩০,০০০ পাউন্ড (১৩,৬০০ কেজি) বোমা ৬১ মিটার (২০০ ফুট) গভীরতায় পৌঁছাতে পারে এবং এর ৫,৩০০ পাউন্ড উচ্চ-বিস্ফোরক ওয়ারহেড কংক্রিট ভেদ করতে সক্ষম। এটি শুধু B-2 স্পিরিট স্টিলথ বোমারু বিমান দ্বারা বহন করা যায়, যা ইসরায়েলের কাছে নেই। ইসরায়েলের GBU-28 (৫,০০০ পাউন্ড) বা BLU-109 বোমাগুলো মাত্র ৬-৭ মিটার কংক্রিট ভেদ করতে পারে, যা ফোরদোর জন্য অপর্যাপ্ত। এমনকি GBU-57-এর জন্যও একই স্থানে একাধিক আঘাত প্রয়োজন হতে পারে।

৩. সাম্প্রতিক হামলার সীমিত প্রভাব:
ইসরায়েল অলরেডি ফোরদোতে হামলা চালিয়েছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) জানিয়েছে, কেন্দ্রটির মূল অবকাঠামোতে “খুবই সীমিত ক্ষতি হয়েছে ”। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, উপরের কিছু স্থাপনায় আঘাত হলেও ৩,০০০ সেন্ট্রিফিউজ সমৃদ্ধ ভূ-গর্ভস্থ চেম্বার একেবারে অক্ষত আছে। নাতাঞ্জের তুলনায় ফোরদোর অবকাঠামো অনেক বেশি শক্তিশালী।

৪. উন্নত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা:
ফোরদো ইরানের S-300 এবং সম্ভাব্য রাশিয়ার S-400 মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সুরক্ষিত। এই সিস্টেমগুলো ২০০ কিলোমিটার দূরত্বে স্টেলথ বিমান সনাক্ত করতে পারে। যদিও ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলায় কিছু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবুও ফোরদোর চারপাশে মাল্টি-লেয়ার প্রতিরক্ষা এবং IRGC-এর কঠোর নিরাপত্তা হামলাকে জটিল করেছে।

৫. পারমাণবিক বোমার সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা:
থিওরিটিক্যালি, একটি পারমাণবিক বোমা, বিশেষ করে গ্রাউন্ড-পেনিট্রেটিং ওয়ারহেড (যেমন আমেরিকার B61-11, ৪০০ কিলোটন শক্তি), ফোরদো ধ্বংস করতে পারবে। এর শকওয়েভ (কয়েক মেগাপাস্কেল চাপ) এবং তীব্র তাপ (লক্ষাধিক ডিগ্রি সেলসিয়াস) পাহাড়ের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে কাঠামোগত ক্ষতি করতে পারে। তেজস্ক্রিয় দূষণ কেন্দ্রটিকে দীর্ঘমেয়াদে অকার্যকর করবে। তবে, ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা এবং পারমাণবিক হামলার বিশাল ঝুঁকি এটিকে অসম্ভব করে।

৬. বিকল্প পদ্ধতির প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ:
• উপরের অবকাঠামোতে হামলা: বিদ্যুৎ বা বায়ুচলাচল সিস্টেমে হামলা ফোরদোকে সাময়িকভাবে বন্ধ করতে পারে, কিন্তু ব্যাকআপ জেনারেটর এবং স্বয়ংক্রিয় ফিল্টার সিস্টেম এর প্রভাব কমিয়েছে।
• কমান্ডো অভিযান: ইলেকট্রনিক নজরদারি, মোশন সেন্সর, এবং IRGC-এর ২৪/৭ নিরাপত্তা গোপন অভিযানকে ঝুঁকিপূর্ণ করেছে।
• সাইবার হামলা: স্টাক্সনেটের মতো হামলা সেন্ট্রিফিউজে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, কিন্তু ফোরদোর এয়ার-গ্যাপড সিস্টেম এবং উন্নত সাইবার প্রতিরক্ষা এটিকে কঠিন করে রেখেছে।

৭. ইসরায়েলের রাজনৈতিক ও কৌশলগত সীমাবদ্ধতা:
আমেরিকা ইসরায়েলকে GBU-57 বোমা বা B-2 বিমান দেয়নি, কারণ এটি আঞ্চলিক যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়ায়। ইসরায়েলের F-35I স্টেলথ ফাইটারের পে-লোড (১৮,০০০ পাউন্ড) ফোরদোর জন্য অপ্রতুল। পারমাণবিক হামলা অসম্ভব, কারণ এটি বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করবে এবং ইরানের শাহাব-৩ বা সেজ্জিল মিসাইল দিয়ে প্রতিশোধমূলক হামলার ঝুঁকি তৈরি করবে।

৮. আমেরিকা কেন পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করবে না:
– ১৯৪৫ সালের পর পারমাণবিক অস্ত্র যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়নি। ফোরদোতে এটি ব্যবহার আমেরিকাকে জাতিসংঘের নিন্দা, নন-প্রলিফারেশন ট্রিটি লঙ্ঘন, এবং মিত্রদের সমর্থন হারানোর ঝুঁকিতে ফেলবে।
– হামলা ইরানের জনবসতি ও পরিবেশকে দূষিত করবে, যা মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন হিসেবে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তুলবে।
– ইরান আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্যের ঘাঁটি বা মিত্রদের (যেমন সৌদি আরব, ইউএই) উপর মিসাইল হামলা চালাতে পারে, যা বৃহৎ যুদ্ধের সূচনা করবে।
– আমেরিকা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধে নিষেধাজ্ঞা, কূটনীতি, বা সাইবার হামলার মতো কম ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতি প্রয়োগর অগ্রাধিকার দেয়।

৯. ফোরদোর প্রকৌশলগত শ্রেষ্ঠত্ব:
২০০০-এর দশকে “আমাদ প্ল্যান” এর অংশ হিসেবে নির্মিত ফোরদোর আয়তন ৫৪,০০০ বর্গফুট। এর ৩,০০০ IR-1 সেন্ট্রিফিউজ ইউরেনিয়ামকে ৮৩.৭% বিশুদ্ধতায় সমৃদ্ধ করতে পারে। মডুলার ডিজাইন, শক-অ্যাবজর্বিং ফাউন্ডেশন, এবং বিমান হামলা প্রতিরোধী নকশা এটিকে অত্যন্ত শক্তিশালী করেছে।

ফোরদোর গভীর ভূ-গর্ভস্থ অবস্থান, উন্নত প্রকৌশল, এবং ইসরায়েলের সীমিত অস্ত্র দিয়ে এই স্থাপন ধ্বংস করা অলমোস্ট অসম্ভব। পারমাণবিক বোমা তাত্ত্বিকভাবে এটি ধ্বংস করতে পারলিও, বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞা, ইরানের প্রতিশোধ, তেজস্ক্রিয় দূষণ, এবং আমেরিকা ও ইসরায়েলের কৌশলগত সীমাবদ্ধতার জন্য তা অবাস্তব । বিকল্প পদ্ধতি যেমন সাইবার হামলা বা কূটনৈতিক চাপই বেশি সম্ভাব্য, যদিও এগুলো ফোরদোর মূল অবকাঠামো ধ্বংস কাজ করবে না।

লেখক : সামরিক বিশ্লেষক

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top