ইরান, ইসরাইল, ইরানে ইসরাইলের হামলা, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের পরমাণু আলোচনা,

ইরান-ইসরাইল : এক সময়ের ‘বন্ধু’ যেভাবে হয়ে উঠল চিরশত্রু

টুডে ডেস্ক

দীর্ঘ সময় ধরে বৈরিতার পর্দার আড়ালে থাকা ইরান ও ইসরাইলের শত্রুতা এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রকাশ্য যুদ্ধের রূপ নিচ্ছে। ২০২৩ সালে গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের পর থেকে স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনবার সরাসরি সঙ্ঘাতে জড়িয়েছে এ দুই দেশ। সর্বশেষ সংঘর্ষে, যা আট দিন ধরে চলেছে, উভয়পক্ষই একে অপরের ভূখণ্ডে হামলা চালিয়েছে।

ইসরাইলের দাবি, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে, যদিও এর কোনো নিশ্চিত প্রমাণ নেই। অন্যদিকে, ইরান বলছে তাদের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে, অস্ত্র তৈরির জন্য নয়। তবে এই মতবিরোধের গভীরে রয়েছে এক জটিল ইতিহাস—যেখানে এক সময়ের বন্ধুত্ব পরিণত হয়েছে ঘোর বিরোধে।

১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় হিসেবে ইরান তাদেরকে স্বীকৃতি দেয়। তখন ইরানের রাজা মোহাম্মদ রেজা পাহলভির নেতৃত্বাধীন পাহলভি রাজবংশ পশ্চিমাপন্থী ছিল এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে নিজেদের কৌশলগত অবস্থান মজবুত করতে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে।

১৯৫০ ও ৭০-এর দশকে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে ছিল গোপন কিন্তু দৃঢ় সম্পর্ক। ইরান ইসরাইলের প্রধান তেল সরবরাহকারী ছিল, অন্যদিকে ইসরাইল ইরানকে অস্ত্র ও গোয়েন্দা সহায়তা সরবরাহ করতো। এমনকি ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা সাভাক গঠনে মোসাদের সাহায্য ছিল বলে সিআইএ এর নথিতে উল্লেখ আছে।

তবে ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে যখন আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইরান ইসলামি প্রজাতন্ত্রে রূপ নেয়, তখনই সম্পর্কের নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। ইসরাইলকে ‘ছোট শয়তান’ আখ্যা দিয়ে খোমেনি সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ইসরাইলি দূতাবাসকে ফিলিস্তিনি দূতাবাসে রূপান্তরিত করা হয় এবং প্রতিবছর রমজানের শেষ শুক্রবার ‘আল-কুদস দিবস’ হিসেবে ইসরাইলবিরোধী বিক্ষোভ আয়োজন শুরু হয়।

এরপর থেকে ইরান ফিলিস্তিন, লেবানন ও সিরিয়ায় ইসরাইলবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠে। হিজবুল্লাহ ও হামাসকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। ইরান নিজেকে মুসলিম বিশ্বের ইসরাইলবিরোধী নেতৃত্বের আসনে বসাতে চায়, যা আরব বিশ্বে জাতীয়তাবাদী শাসকদের রক্ষণাত্মক অবস্থানে ঠেলে দেয়।

প্রকাশ্য বৈরিতার মাঝেও ১৯৮০-এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধে ইসরাইল গোপনে ইরানকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল, যা ‘ইরান-কনট্রা কেলেঙ্কারি’ হিসেবে পরিচিত। সেই সময় ইসরাইল মনে করেছিল, ইসলামি বিপ্লবী ইরানের তুলনায় সাদ্দাম হোসেনের ইরাক তাদের জন্য বেশি হুমকি।

তবে ১৯৯০-এর দশকে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির সূত্র ধরে ইসরাইল-ইরান সম্পর্ক পুরোপুরি বৈরিতার পর্যায়ে পৌঁছায়। এরপর ইরান হিজবুল্লাহ, হামাস, হুতি বিদ্রোহীসহ ‘প্রতিরোধ অক্ষ’-এর নেতৃত্ব দিতে শুরু করে। অন্যদিকে, ইসরাইলও ইরানবিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা দিয়ে আসছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই বৈরিতা ছায়াযুদ্ধে রূপ নেয় সাইবার হামলা, ড্রোন ব্যবহার, গুপ্তহত্যা ও সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে। সিরিয়া, লেবানন, ইরাক ও ইয়েমেনে ইরানের প্রভাব যত বাড়ে, তত ইসরাইল উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে জবাব দিতে থাকে।

২০২৪ সালে এসে সংঘাত চূড়ান্ত রূপ নেয়। গাজায় যুদ্ধ, প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যু, হামাস নেতা ও আইআরজিসি কমান্ডারদের হত্যাকাণ্ড—সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্য উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দুই দেশ একে অপরের ওপর সরাসরি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।

বিস্ময়ের বিষয় হলো, একসময় যারা বন্ধু ছিল, আজ তারা চিরশত্রু। এবং বিপরীতে, আরব দেশগুলো—যারা এক সময় ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল—আজ তারা ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে বা করার পথে রয়েছে। সৌদি আরব, বাহরাইন, আমিরাত, ওমানসহ একাধিক আরব দেশ এখন ইসরাইলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে।

এই বাস্তবতা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে এক অভূতপূর্ব পালাবদল। যে ইরান একসময় ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল, এখন তা সবচেয়ে বড় শত্রু। আর আরব বিশ্ব, যারা একসময় একের পর এক যুদ্ধ চালিয়েছিল ইসরাইলের বিরুদ্ধে, এখন শান্তি ও স্বীকৃতির পথে হাঁটছে।

সূত্র : আল-জাজিরা ও ইকোনমিক টাইমস।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top