ইরানের সামরিক কৌশলটা এখন অনেকটা ধৈর্য আর ক্যালকুলেশনের খেলা। একেবারে যেন দাবার মতো—প্রথমে ছোট চাল দিয়ে প্রতিপক্ষকে ক্লান্ত করো, তারপর মূল আঘাত হানো। ওদের মূল থিওরিটা হলো—কম খরচের ড্রোন আর পুরনো মিসাইল দিয়ে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যস্ত ও দুর্বল করে তুলো, তারপর হাইপারসনিক মিসাইল দিয়ে চূড়ান্ত আঘাত করো। সহজ ভাষায়, এটা “ওয়েভ স্ট্র্যাটেজি”—একটার পর একটা তরঙ্গ আকারে হামলা চালিয়ে প্রতিপক্ষকে ভাঙা।
ইরান তাই শুরুতেই Shahid সিরিজের ড্রোন, ফজর বা কাসেমের মতো তুলনামূলক পুরনো ধরনের মিসাইল দিয়ে একটা ব্যারেজ তৈরি করে। এসব অস্ত্র সস্তা, কিন্তু সংখ্যায় অনেক। আর ইসরাইলের আয়রন ডোম যে Tamir ইন্টারসেপ্টর ব্যবহার করে, তার প্রতিটা ব্যয় কয়েক লাখ ডলার। প্রতিটি Shahid ড্রোন নামাতে যে খরচ হয়, তাতে ইসরাইল আস্তে আস্তে ব্যয়বহুল এক যুদ্ধে জড়াবে, যেটা দীর্ঘস্থায়ী হলে টিকিয়ে রাখা কঠিন।
আর এখানেই ইরানের আসল চাল। যখন ডিফেন্স সিস্টেম ক্লান্ত, ইন্টারসেপ্টর মিসাইল অনেকটা খরচ হয়ে গেছে—ঠিক তখনই তারা পাঠাতে থাকবে তাদের গর্ব, “Fattah-1” হাইপারসনিক মিসাইল। এই মিসাইল এত দ্রুতগতির, এত শক্তিশালী, যে সাধারণ আকাশ প্রতিরক্ষা দিয়ে ঠেকানো প্রায় অসম্ভব। তখন আর প্রতিরোধ নয়, আঘাতটাই মূল দৃশ্য হয়ে দাঁড়ায়।
ইরানের কাছে এখন বিশাল একটা ইনভেন্টরি আছে—তাদের হাতে আছে প্রায় তিন হাজার ব্যালিস্টিক মিসাইল, চার হাজারের বেশি বিভিন্ন রকম ড্রোন, অনেক “লোইটারিং মিউনিশন” যেগুলো নির্দিষ্ট টার্গেট খুঁজে গিয়ে নিজেই বিস্ফোরিত হয়, আর আছে পঞ্চাশটির মতো নিজস্ব ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কারখানা। অর্থাৎ, ইরান প্রতিনিয়ত নিজেরাই অস্ত্র তৈরি করছে—যুদ্ধ দীর্ঘ হলে কার ঘর আগে খালি হবে, সেটা সহজেই বোঝা যায়।
অন্যদিকে ইসরাইলের স্ট্র্যাটেজি একেবারেই আলাদা। তারা জানে, সরাসরি ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ মানে এক ধরনের হাই-রিস্ক গ্যাম্বল। ভূখণ্ডের দিক থেকে ইরান বিশাল, প্রতিরোধের সক্ষমতাও প্রবল, এবং একটা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ মানেই গোটা অঞ্চলের অস্থিরতা। তাই ইসরাইল নিচ্ছে টার্গেটেড স্ট্রাইক—যার মূল লক্ষ্য ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, সামরিক গবেষণাগার, রেভ্যুলুশনারি গার্ডের কমান্ড সেন্টার বা ড্রোন ফ্যাক্টরি। এক কথায়, মাথা কেটে ফেলো—হাত-পা আপনাতেই অচল হয়ে যাবে।
ইসরাইল চাইছে, এইসব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ক্ষতি করে ইরানকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দিতে। সেইসাথে তারা বড় কৌশলের দিকেও তাকিয়ে আছে—যদি কখনো সুযোগ আসে, তবে রেজিম পরিবর্তনের মাটিও তৈরি করতে চায়। কারণ, ইসরাইলসহ পশ্চিমারা এখনো “শাহ-যুগের ইরান” ফিরে পেতে চায়—যেখানে শাসক পশ্চিমঘেঁষা, আর ধর্ম নয়, রাজনৈতিক আধিপত্যই মুখ্য।
ইসরাইলের হাতেও আছে অত্যাধুনিক অস্ত্রভাণ্ডার। যেমন, বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক স্টেলথ ফাইটার জেট F-35A, যার ৩০টিরও বেশি ওদের কাছে আছে। এছাড়া ছয়শরও বেশি যুদ্ধবিমান, সর্বোচ্চ মানের সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স ও স্যাটেলাইট সাপোর্ট—সব মিলিয়ে ওদের সক্ষমতা চোখ ধাঁধানো। কিন্তু সমস্যা হলো, প্রতিরক্ষা ব্যয়—যেখানে প্রতিটা ইন্টারসেপ্টর মিসাইলের দাম কয়েক লাখ ডলার, সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী যদি হাজারে হাজারে সস্তা ড্রোন ছুঁড়ে মারে, তখন প্রযুক্তি থাকলেও তা কতক্ষণ কার্যকর থাকে, সেটা বড় প্রশ্ন।
এই মুহূর্তে যুদ্ধ সরাসরি মাঠে নয়, বরং ঘুরপথে চলছে। প্রতিটি হামলা হিসাব করে হচ্ছে। ইরান খেলছে সস্তা কিন্তু লাগাতার ধাক্কার খেলা—যা অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে। আর ইসরাইল খেলছে সূক্ষ্ম, সুনির্দিষ্ট অপারেশনের খেলা—যার লক্ষ্য ইরানের গঠন কাঠামোতে ফাটল ধরানো।
এই যুদ্ধে কে জিতবে? এখনই বলা মুশকিল। তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, এ যুদ্ধ ইরানের জন্য তীব্রতর অশনি সংকেত ৷ এই লড়াই শুধু বোমা আর মিসাইলের নয়, এটা এক ধরনের ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি—যেখানে ধৈর্য, পরিকল্পনা আর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য—সবকিছু মিলেই আসল যুদ্ধের রূপরেখা তৈরি করছে।