ইরানের উপর ইসরাইলি বিমান হামলার প্রেক্ষাপটে অধিকৃত পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনি জনগণের উপর ব্যাপক অবরোধ আরোপ করেছে ইসরাইল। টানা তৃতীয় দিনের মতো এই অবরোধ অব্যাহত রয়েছে, যার আওতায় বহু শহর ও গ্রাম। এসব এলাকার প্রবেশপথ লোহার গেট ও কংক্রিটের প্রাচীর দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
আল জাজিরার সংবাদদাতা নিদা ইব্রাহিমের তথ্যানুযায়ী, ইসরাইল শহর ও গ্রামগুলো কার্যত সিলগালা করে চলাচল সীমাবদ্ধ করেছে, প্রধান সড়কগুলোতে নতুন চেকপয়েন্ট বসিয়েছে এবং ফিলিস্তিনিদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করছে।
ফিলিস্তিনি সংবাদ সংস্থা ওয়াফা নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, রামাল্লা, আল-বিরেহ, নাবলুস, হেবরন, কালকিলিয়া ও জর্ডান উপত্যকায় ইসরাইলি সেনা উপস্থিতি ও চেকপয়েন্টের কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। কৃষকরা তাদের জমিতে যেতে পারছেন না, কৃষি পণ্য পরিবহনও মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এই অবস্থার মধ্যে ইসরাইলি বাহিনী তুলকার্ম শরণার্থী শিবিরে অভিযান চালিয়ে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরকে গুলি করে হত্যা করেছে এবং রাতভর অভিযান চালিয়ে পশ্চিমতীর থেকে অন্তত ১৫ জনকে গ্রেফতার করেছে।
জাতিসঙ্ঘের হিসেবে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে পশ্চিমতীরে ইসরাইলি অভিযানে ৯৪৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ২০০ জনেরও বেশি শিশু। এ বছর এখন পর্যন্ত পশ্চিমতীরে ১৩৭ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে।
ফিলিস্তিনিরা বলছেন, এই অবরোধ ও সহিংসতার পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো তাদের জমি দখল এবং অবৈধ ইসরাইলি বসতি সম্প্রসারণ। মার্চে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার দফতরের প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২৪ সালে বসতি নির্মাণ ও ভূমি অধিগ্রহণ তীব্রতর হয়েছে, যা দীর্ঘদিনের দখল নীতিরই অংশ।
অবরোধের কারণে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রমও চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এক অ্যাম্বুলেন্স চালক জানিয়েছেন, অনুমতি থাকা সত্ত্বেও তিন-চার ঘণ্টা চেকপয়েন্টে আটকে রাখা হয়। বাধ্য হয়ে রোগীদের একটি অ্যাম্বুলেন্স থেকে আরেকটিতে স্থানান্তর করতে হয়।
ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা নিয়েও উদ্বেগ বাড়ছে। তারা ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ও সম্পত্তিতে হামলা চালাচ্ছে। বসতির সংখ্যা ও পরিসর বাড়াতে এই অবরোধকে কাজে লাগাচ্ছে কিছু বসতি স্থাপনকারী। গত সপ্তাহে ইসরাইলের কয়েকজন মন্ত্রী গাজা ও পশ্চিমতীর পুরোপুরি দখলের পক্ষে মত দেন, যার মধ্যে অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ এবং যোগাযোগমন্ত্রী শ্লোমো কারহি রয়েছেন।
এই প্রেক্ষাপটে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) কর্মকর্তা কাসেম আওয়াদ জানান, ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে পশ্চিমতীরে চেকপয়েন্ট ও রোডব্লকের সংখ্যা ৬০০ থেকে বেড়ে ৯০০ হয়েছে। তার ভাষায়, ‘তারা (ইসরাইল) ইরানের সাথে যুদ্ধের এই সময়কে কাজে লাগিয়ে ফিলিস্তিনিদের গাজার মতো বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে।’
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই পরিস্থিতির প্রতি খুব কমই মনোযোগ দিচ্ছে। ইউএনআরডব্লিউএ এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘পশ্চিমতীর যুদ্ধক্ষেত্র নয়।’ তারা ইসরাইলি বাহিনীকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও আইন প্রয়োগকারী আচরণবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে কাজ করছে। তবে অধিকাংশ ফিলিস্তিনি মনে করেন, ইসরাইলি দখলদারিত্বের কারণে তাদের সরকারের ক্ষমতা গুরুতরভাবে সীমিত।
এই প্রেক্ষাপটে, ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে চলমান উত্তেজনার সুযোগে ইসরাইলের পশ্চিমতীরের দখল ও দমননীতির নতুন মাত্রা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সূত্র : আল জাজিরা