ইরান, ট্রাম্প, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল, নেতানিয়াহু, পারমাণবিক কর্মসূচি,

ইরানে মার্কিন হামলার ফলাফল কী দাঁড়ালো

টুডেনিউজ ডেস্ক

যুদ্ধে রাজনীতির মতো সবসময় জয়ই মুখ্য নয়। অনেক সময় শুধু নিয়ন্ত্রণে থাকার আভাস দিতে হয়। প্রতিপক্ষ, শ্রোতা বা মিত্রদের বোঝানোই যথেষ্ট যে আপনিই খেলাটি পরিচালনা করছেন। এমনকি আপনি পতনের দ্বারপ্রান্তে থাকলেও, এই অবস্থান ধরে রাখতে হয়। ইরানের বিরুদ্ধে হঠাৎ উত্তেজনা বৃদ্ধির পর ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর আচরণ এমনটিই ইঙ্গিত করে।

ইরানের অভ্যন্তরে একের পর এক হামলা, পরস্পরবিরোধী বার্তা, শক্তি ও সার্বভৌমত্বের প্রদর্শন এসবই এ কথা প্রমাণ করে যে নেতানিয়াহু আজ নিজ দেশে এবং গাজাতেও নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন। তাই তিনি অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে এমন এক নেতার ছায়া অবলম্বন করে, যিনি এখনো নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছেন, যদিও তার অবস্থানেও ফাটল দেখা দিয়েছে।

গাজায় কোনো সমাধান নেই

২০২৫ সালের জুনের শুরুতে ইসরাইল ইতিহাসের অন্যতম জটিল কৌশলগত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। গাজায় কোনো বিজয় নেই, নেই চুক্তির সম্ভাবনাও।

ট্রাম্প প্রশাসন যুদ্ধবিরতির জন্য দুর্বল কূটনৈতিক উদ্যোগ নিচ্ছে। ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকেরা আরেকটি অনিশ্চিত যুদ্ধে জড়াতে চাইছে না। গত সপ্তাহে প্রকাশিত অ্যাক্সিওসের এক প্রতিবেদনে পেন্টাগনের পক্ষ থেকে তেহরানের সাথে উত্তেজনা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আপত্তির কথা বলা হয়েছে।

ইসরাইলি সেনাবাহিনী ক্লান্ত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বিরোধী অবস্থানে রয়েছে। তবুও নেতানিয়াহু নতুন নতুন ফ্রন্ট খুলছেন, যা খুবই ব্যয়বহুল, এদিকে হাউছিদের হামলাও অব্যাহত। অভ্যন্তরেও রকেট হামলা, আস্থার সঙ্কট ও বিভক্ত অবস্থা। এই অচলাবস্থার মধ্যেই নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক মহলে এক নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে। এখনই কি গাজায় বন্দী বিনিময়ের চুক্তির সময়, নাকি ইসরাইলকে কৌশলগত অবরোধ থেকে মুক্ত করতে আরেকটি যুদ্ধের প্রয়োজন?

নেতানিয়াহুর কাছে চুক্তির পথ ছিল হতাশাজনক। কারণ সেটি তার রাজনৈতিক পতনের সূচনা ঘটাতে পারতো। তাই ইরানের বিরুদ্ধে উত্তেজনা তার কাছে ছিল দ্বিমুখী কৌশল: একদিকে মনোযোগ সরিয়ে দেয়া, অন্যদিকে আমেরিকাকে হস্তক্ষেপে বাধ্য করা, যদিও ওয়াশিংটন, এমনকি ট্রাম্পও উত্তেজনা কমাতে চাইছিল।

তেহরানের দিকে : এগিয়ে যাওয়া মানেই উন্মাদনা নয়

ইরানে হামলার সিদ্ধান্ত শুধু সামরিক অভিযান ছিল না। এটি ছিল দীর্ঘদিনের অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক হিসাব-নিকাশের পরিণতি। ইসরাইল এককভাবে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করতে পারবে না। কারণ ফোরদো পাহাড়ের গভীরে এবং নতুন নাতানজ অত্যন্ত সুরক্ষিত। এটি মোসাদ ও সামরিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে চিফ অফ স্টাফ ইয়াল জামির ভালো করেই জানেন।

তবে ইসরাইলের অন্য একটি শক্তি আছে। পরিকল্পিত উত্তেজনা সৃষ্টি করা, পরিস্থিতি এলোমেলো করে দেয়া এবং এমন একটি আন্তর্জাতিক সঙ্কট তৈরি করা, যা আমেরিকাকে বিব্রত করে হস্তক্ষেপে বাধ্য করে। মনে হচ্ছে, ইসরাইল তাতে কিছুটা সফলও হয়েছে।

আজকের মার্কিন হামলার পর প্রধান প্রশ্ন হলো, এটি কি সত্যিই ইরানের হুমকি দূর করতে করা হয়েছিল, নাকি ওয়াশিংটন এটিকে দর কষাকষির হাতিয়ার বানিয়ে ইরানের সাথে এক বৃহত্তর সমঝোতার পথ তৈরি করতে চায়, যা ইসরাইলের ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে আলোচনার পটভূমি বদলে দেবে?

যদিও নেতানিয়াহু সামরিক পথকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন, তিনিও জানেন যে ট্রাম্প দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে যেতে রাজি নন।

বাক্য থেকে বাস্তবতায় : বক্তৃতার আগুন না কর্মের আগুন?

দেশে নেতানিয়াহু তার পরিচিত অস্ত্র ব্যবহার করেছেন অর্থাৎ উসকানিমূলক বক্তৃতা। যেমন, ‘আমরা ইরানের সব স্থাপনায় আঘাত করতে পারি’, ‘তেহরানকে হাঁটু গেড়ে বসাতে চাই’, কিংবা ‘নাসরাল্লাহকে হত্যা করে ইরানি অক্ষ ভেঙে দিয়েছি।’ এসব বক্তব্য ইতিহাসের রূপক ও মহাকাব্যিক ভাষায় মোড়ানো। কিন্তু এর অন্তরালে একটি নির্মম সত্য রয়েছে। তা হলো, ইসরাইল যেকোনো পরিস্থিতিতেই আমেরিকার সহায়তা ছাড়া চলতে পারে না। ইরানের শাসনব্যবস্থা পতনের জন্য তাদের দরকার পেন্টাগনের চাবিকাঠি; পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংসের জন্য দরকার আমেরিকান বোমারু বিমান; আর কূটনৈতিক চুক্তির জন্য প্রয়োজন ওয়াশিংটনের ছায়া।

এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন হলো ইসরাইল কি এখন হাল ছেড়ে ফলাফলের জন্য ওয়াশিংটনের উপর ভরসা করবে, নাকি আগুন লাগানোর অধিকার নিজের হাতেই রাখবে?

পার্ল হারবার থেকে হিরোশিমা : অতিরঞ্জনের ফাঁদ

ইসরাইলি কর্মকর্তারা এখন তুলনা করছেন, ‘উল্টো পার্ল হারবার’, ‘ইরানি হিরোশিমা’, বা ‘১৯৬৭ সালের মতো একটি মধ্যপ্রাচ্য বদলে দেয়া হামলা।’ কিন্তু ইতিহাসের আয়নায় দুর্বলতাই বেশি ধরা পড়ে। ইরান দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, সংবেদনশীল এলাকাগুলোকে লক্ষ্য করেছে, যার ফলে সামরিক ও সরকারি মহলে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়েছে।

কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিদেশী সংবাদমাধ্যমের সরঞ্জাম বাজেয়াপ্ত, আরব সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসাবাদ, সেন্সরশিপ, সবই চালু হয়। উদ্দেশ্য শুধু নিরাপত্তা রক্ষা নয়। বরং ‘উপযুক্ত’ বয়ান তুলে ধরা।

ইসরাইলি জরুরি কর্তৃপক্ষ জানায়, ক্ষতিপূরণের দাবি ২২ হাজার ছাড়িয়েছে। এছাড়া ৮ হাজার ইসরাইলি বাস্তুচ্যুত, অভ্যন্তরীণ পর্যটন ৪০ শতাংশ কমেছে। আকাশসীমা পুরোপুরি বন্ধ করার কথাও উঠেছে। তবে এখনো বড় কোনো বিক্ষোভ দেখা যায়নি। বন্দী পরিবারগুলোর পক্ষ থেকেও নয়। কেন?

দুই দশক ধরে নেতানিয়াহু যুদ্ধকে ‘অস্তিত্বের প্রশ্ন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। ১৯৬৭ সালের বয়ান পুনরুজ্জীবিত করেছেন। তবে এই ঐক্য টিকে থাকবে কিনা, তা প্রশ্নসাপেক্ষ, বিশেষত যদি যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয় বা কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়।

ইরানের প্রতিক্রিয়া : শোম্যানশিপ আর সতর্কতার মাঝে

তেহরানের প্রতিক্রিয়া সীমিত হলেও তা ইসরাইলি মনোজগতে যুদ্ধের সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছে। আইএনএসএস-এর বিশ্লেষকদের মতে, ইরান একটি মাপজোখ করা প্রতিক্রিয়া বেছে নিয়েছে, সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়িয়ে ক্ষমতা দেখিয়েছে। অন্যদিকে, কেউ কেউ মনে করছেন যে এই প্রতিক্রিয়াই প্রমাণ করে ইসরাইল ইরানের ‘লাল রেখা’ অতিক্রম করেছে।

এই মতপার্থক্য শুধু গবেষণাকেন্দ্রেই নয়, রাজনৈতিক অভিজাতদের মধ্যেও। নেতানিয়াহু যখন একে ‘বড় সাফল্য’ বলছেন, অন্যরা বলছেন ‘কৌশলহীন অভিযান’। আবার কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, নেতানিয়াহু কেবল নিজের টিকে থাকার জন্য আমাদের সঙ্ঘাতের দিকে টেনে নিচ্ছেন।’

ইসরাইল কিভাবে দেখছে ইরানকে?

ইসরাইলের কাছে ইরান শুধু পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে চাওয়া রাষ্ট্র নয়। বরং গাজা, ইয়েমেন, ইরাক, লেবানন পর্যন্ত বিস্তৃত একটি অক্ষের কেন্দ্র।

তবে হামাস বা হিজবুল্লাহর সাথে যেভাবে যুদ্ধ হয়, ইরানের ক্ষেত্রে তা নয়। এখানে যুদ্ধ প্রতীকী ও কৌশলগত।লক্ষ্য রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ধ্বংস, প্রতিরোধ ভেঙে ফেলা, এমনকি ইরানকে এমন এক দিক থেকে চাপ দেয়া যেন তারা নিজেরাই ধ্বংসের পথে হাঁটে।

শেষে যা দাঁড়ায়

ইসরাইল এখন শুধু এক মোড়ে দাঁড়িয়ে নয়। বরং এক আয়নার সামনে, যেখানে তার দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। গাজায় কিছুই অর্জন হয়নি। অভ্যন্তরে ক্লান্তি, বাইরে বৈধতার সঙ্কট, এমনকি আমেরিকাও শান্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছে।

এই ক্ষয়ের মধ্যে ইরানে হামলা যেন পুনরুদ্ধারের শেষ চেষ্টা অথবা এক ঝুঁকিপূর্ণ ঝাঁপ। গাজা যুদ্ধের শেষ বা ইরানের সাথে চুক্তি ছাড়া ইসরাইলের হাতে কোনো তাস আর অবশিষ্ট থাকবে না।

আসল বিপদ হামলার মাত্রায় নয়, বরং প্রস্থান কৌশলের অভাবে। প্রতিটি ফ্রন্ট এখন একেকটি বোঝা, প্রতিটি রকেট এক ধ্বংসাত্মক সঙ্ঘর্ষের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নিজের সাথে, অন্য কারো নয়। যা একটি অগ্রসর পদক্ষেপ মনে হচ্ছে, তা হয়তো শেষ বিপর্যয়ের শুরু। বিশেষ করে যখন যুদ্ধ হয় কোনো ছাদ ছাড়াই, পরিকল্পনা ছাড়াই, মিত্র ছাড়াই।

সম্ভবত এ কারণেই ইসরাইল এখন আগের চেয়ে বেশি শক্তিশালী… এবং আগের চেয়ে বেশি ভঙ্গুর!

সূত্র : আল জাজিরা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top