২০২৫ সালের ২৪ জুন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে চলমান ১২ দিনের যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি ঘোষণা করেন। এই ঘোষণায় মধ্যপ্রাচ্যসহ সমগ্র বিশ্ব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি কেবল একটি অস্থায়ী কূটনৈতিক সাফল্য, যা প্রকৃতপক্ষে এক নতুন, আরো বিপজ্জনক অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
যুদ্ধবিরতি জড়িত সব পক্ষের জন্যই কৌশলগত সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, তারা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর আঘাত হেনে উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। ট্রাম্পের ভাষায়, এই সামরিক পদক্ষেপ একটি পূর্ণাঙ্গ আঞ্চলিক যুদ্ধের দিকে না গিয়েই লক্ষ্য পূরণ করেছে, যা তার প্রশাসনের সরাসরি সামরিক সম্পৃক্ততা এড়ানোর নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
অন্যদিকে, ইরানের দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধবিরতি একটি দীর্ঘমেয়াদি সঙ্ঘাত এড়ানোর সুযোগ দিয়েছে, যা দেশটির শাসকগোষ্ঠীর অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারতো। যদিও তেহরান স্বীকার করেছে যে তাদের কিছু পারমাণবিক স্থাপনায় ক্ষতি হয়েছে। তারা জোর দিয়ে বলেছে যে তাদের সামগ্রিক কর্মসূচি এখনো অক্ষত এবং কার্যকর রয়েছে। এই বার্তা একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ইরানের অবস্থান বজায় রাখার কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তবে এই যুদ্ধবিরতি ইরান-ইসরাইল দ্বন্দ্বের মূল সমস্যাগুলোর কোনো সমাধান এনে দেয়নি। বরং এটি ইঙ্গিত দেয় যে এই দ্বন্দ্ব প্রক্সি সংঘর্ষের পর্যায় থেকে সরাসরি যুদ্ধের স্তরে পৌঁছে গেছে। বিশেষ করে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের ঘটনার পর, যা সঙ্ঘাতের গতিপথ পাল্টে দেয়। সাম্প্রতিক যুদ্ধ পূর্বের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করে ভবিষ্যতে আরো সরাসরি ও তীব্র সঙ্ঘর্ষের ঝুঁকি তৈরি করেছে।
এছাড়া ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ক্ষতির মাত্রা নিয়ে পক্ষগুলোর বক্তব্যেও পার্থক্য রয়েছে। ট্রাম্প যেখানে সম্পূর্ণ ধ্বংসের দাবি করেছেন, ইসরাইলি গোয়েন্দা তথ্য বলছে যে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে বটে। তবে কর্মসূচি পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। ইরান এই দাবিগুলো খাটো করে দেখিয়ে বলেছে, তাদের কর্মসূচি এখনো চলমান।
এই যুদ্ধবিরতির ফলে পারমাণবিক ইস্যুতে ইরান ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর মধ্যে আলোচনা পুনরায় শুরু হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করার সম্ভাবনা ক্ষীণ। যুদ্ধের পর নিজেকে বিজয়ী হিসেবে তুলে ধরার কৌশলের অংশ হিসেবে ইরান তার কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়াকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে। এটি ভবিষ্যতের জন্য উত্তেজনার একটি স্থায়ী উৎস হয়ে থাকবে।
যুদ্ধের সময় ইরান তার সরাসরি হামলা চালানোর ক্ষমতা দেখিয়েছে, বিশেষ করে ইসরাইলি শহরগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে। অতীতে এমন পদক্ষেপ থেকে ইরান বিরত থাকলেও এই যুদ্ধ পূর্বেকার সংযমের সীমা ভেঙে দিয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে যেকোনো উস্কানির জবাবে তেহরানের প্রতিক্রিয়া আরো সরাসরি এবং সহিংস হতে পারে।
ইরান ইতোমধ্যে তার সামরিক দুর্বলতা চিহ্নিত করেছে। এখন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন শক্তি বাড়ানোর পরিকল্পনা নিচ্ছে। অন্যদিকে, ইসরাইলের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে যে ইরানের বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দেশটি একটি কৌশলগত হুমকি হিসেবেই থাকবে।
যুদ্ধের সময় আঘাতপ্রাপ্ত হলেও ইরান লেবাননে হিজবুল্লাহ, সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরাকে তার মিত্রদের সহযোগিতায় আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক পুনর্গঠনের চেষ্টায় থাকবে। বিশেষত হিজবুল্লাহকে তেহরান তার প্রতিরক্ষার প্রথম স্তর হিসেবে দেখে এবং ভবিষ্যতে তাদের সামর্থ্য পুনরুদ্ধার করাকে একটি অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করছে।
এই প্রেক্ষাপটে ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে ভবিষ্যতে আরো একটি যুদ্ধের সম্ভাবনা দিন দিন বাড়ছে। ইতিমধ্যে এই অঞ্চলে সঙ্ঘাতের মানসিক ও কৌশলগত প্রতিবন্ধকতা ভেঙে পড়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র বিনিময় যে মাত্রায় সংঘটিত হয়েছে, তা ভবিষ্যতের সংঘর্ষকে আরো ভয়াবহ করে তুলবে।
যদিও যুদ্ধবিরতি আপাত শান্তি নিয়ে এসেছে, এটি কেবলমাত্র একটি বিরতি। কিন্তু তা স্থায়ী সমাধান নয়। মৌলিক মতপার্থক্য সমাধান ছাড়া এই সঙ্ঘাত একটি টিকটিক টাইম বোমা হয়ে রয়ে গেছে, যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরিত হতে প্রস্তুত। সব দিক বিবেচনায়, বিশ্লেষকদের মতে ইরান-ইসরাইল সঙ্ঘাতের সবচেয়ে বিপজ্জনক অধ্যায় সম্ভবত ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
সূত্র : আল জাজিরা