ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা

ইরান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে কেন টেনে আনতে চান নেতানিয়াহু

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্যে আবারো স্পষ্ট হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র এখনো ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনায় সামরিক হস্তক্ষেপের সকল বিকল্প বিবেচনায় রাখছে। হোয়াইট হাউসের দক্ষিণ লনে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প বলেছেন, ‘পরের সপ্তাহটি বড় হতে চলেছে।’ তিনি দাবি করেন, ইরানি কর্মকর্তারা তার সাথে আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তবে তিনি একইসাথে সতর্ক করেছেন, ‘এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।’

এই প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইরানের পাহাড়ের গভীরে নির্মিত ফোরদু জ্বালানি সমৃদ্ধকরণকেন্দ্র ধ্বংস করতে পারবে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের বাঙ্কার ধ্বংসকারী বোমা, যা বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমানে বহন করে ফেলা হয়। এ ধরনের হামলা ইসরাইলের কৌশলে এক আমূল পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এটি আর প্রতিরক্ষা নয়। বরং সরাসরি আক্রমণের দিকেই ইসরাইলকে ঠেলে দিচ্ছে।

বাঙ্কার বাস্টার কী?

‘বাঙ্কার বাস্টার’ বলতে বোঝানো হয় এমন বোমাকে, যা ভূগর্ভস্থ বা কংক্রিটের পুরু প্রাচীরের আড়ালে থাকা লক্ষ্যবস্তু ধ্বংসে সক্ষম। মার্কিন সামরিক বাহিনীর জিবিইউ-৫৭ ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। এই নির্ভুল-নির্দেশিত বোমা ২০০ ফুট পর্যন্ত মাটির নিচে ঢুকে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।

এখন পর্যন্ত শুধু যুক্তরাষ্ট্রেরই এই অস্ত্র রয়েছে। আর বি-২ বোমারু বিমানই কেবল এই বিশাল বোমা বহনে সক্ষম। ইসরাইলি বিমানবাহিনীও কিছু সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন মার্কিন বাঙ্কার ধ্বংসকারী বোমা ব্যবহার করে যেমন জিবিইউ-২৮ বা বিএলইউ-১০৯ তারা ব্যবহার করে। তবে সেগুলো ফোরদুর মতো গভীর নিরাপদ স্থাপনায় আঘাত হানতে অক্ষম। ২০২৪ সালে ইসরাইল বিএলইউ-১০৯ ব্যবহার করে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু ভূগর্ভস্থ সুরক্ষা তাকে রক্ষা করে।

কেন ফোরদু এত গুরুত্বপূর্ণ?

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির একটি প্রধান কেন্দ্র ফোরদু, যা তেহরান থেকে প্রায় ৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং কোম শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি প্রায় ৮০-৯০ মিটার ভূগর্ভস্থ, পাহাড়ের খোঁড়া অংশে নির্মিত। ইরান ২০০৯ সালে এই কেন্দ্রের অস্তিত্ব স্বীকার করে। এর নির্মাণ শুরু হয়েছিল ২০০৬ সালের দিকে।

২০১৫ সালের যৌথ পারমাণবিক চুক্তি (জেসিপিওএ) অনুযায়ী, ইরান এই কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থগিত করতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসনের চুক্তি থেকে একতরফাভাবে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইরান পুনরায় এখানে সমৃদ্ধকরণ শুরু করে। অবশ্য ইরান দাবি করছে, তার পারমাণবিক কর্মসূচি পুরোপুরি বেসামরিক। তবুও ইসরাইল এই কেন্দ্রকে অস্তিত্বগত হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে।

ইসরাইলি উদ্বেগ ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা

ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একে ‘অস্তিত্বের হুমকি’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, পুরো অভিযানের চূড়ান্ত লক্ষ্য ফোরদু ধ্বংস করা। যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত ইয়েচিয়েল লেইটার ফক্স নিউজকে বলেন, এই পুরো অভিযান আসলে ফোরদুকে নির্মূল করার মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে।’

তবে ফোরদুর চারপাশে ইরান ও রাশিয়ার সরবরাহকৃত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন রয়েছে। অবশ্য ইসরাইলি হামলায় এই প্রতিরক্ষাও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।

অন্যান্য পারমাণবিক স্থাপনা ও সম্ভাব্য দূষণ

ইসরাইল ইতোমধ্যে ইরানের অপর দু’টি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নাতানজ ও ইসফাহান এ হামলা চালিয়েছে। স্যাটেলাইট চিত্রে এসব স্থাপনায় গুরুতর ক্ষতির প্রমাণ মিলেছে। আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রধান রাফায়েল গ্রোসি জানিয়েছেন, এসব হামলা পারমাণবিক ও রাসায়নিক দূষণের আশঙ্কা তৈরি করছে। যদিও এখনো তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা স্বাভাবিক। কিন্তু সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলে দূষণের ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যেতে পারে।

ইসরাইল মনে করছে, ফোরদু ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতার মূলভিত্তি এবং এটিকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত হুমকি নিরসন হবে না। কিন্তু এই স্থাপনাটি ধ্বংস করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সামরিক সম্পৃক্ততা প্রয়োজন, বিশেষ করে বাঙ্কার ধ্বংসকারী জিবিইউ-৫৭ মোতায়েনের ক্ষেত্রে। ফলে একদিকে এটি যুক্তরাষ্ট্রকে একটি নতুন যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে, অন্যদিকে গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে তেজস্ক্রিয় বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

সূত্র : আল জাজিরা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top