ইসরাইল, ট্রাম্প, হামাস, হাউছি,

ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর বিরোধ চরমে : ইসরাইলকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়ার হুমকি ট্রাম্পের

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে করছেন, ইসরাইল তার উপসাগরীয় সফর নষ্ট করে দিতে পারে এবং এটি সমস্যার সৃষ্টি করছে। মঙ্গলবার থেকে তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় অঞ্চলে সফরের সময় ট্রাম্প চান, মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি পাক। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে ইসরাইল যদি কথা না শোনে, তাহলে ধুলোয় মিশিয়ে দেবেন।

এক সিনিয়র পশ্চিমা কর্মকর্তা মিডল ইস্ট আইকে বলেন, ‘নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের মধ্যে যে ফাটল তৈরি হয়েছে, তা খুবই তীব্র। ইসরাইল ইস্যুতে হতাশাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।’

বিশ্লেষক ও কূটনীতিকদের মতে, সফরের আগেই কিছু সংবেদনশীল ইস্যু নেতানিয়াহুকে বিব্রত করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইরানের সাথে চলমান পারমাণবিক আলোচনা, যাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স সম্প্রতি ‘এখন পর্যন্ত ভালো’ বলে উল্লেখ করেছেন।

গত কয়েক মাসে ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে তিরস্কার করেছেন এবং দাবি করেছেন যে মোসাদের ঘনিষ্ঠ মিডিয়াগুলো তাকে বাধা দিতে চাইছে। তিনি স্বীকার করেছেন, ইসরাইল ইরানের ওপর হামলার জন্য চাপ দিলেও তিনি তা প্রতিহত করেছেন।

অন্যদিকে, ট্রাম্প গাজায় যুদ্ধ শুরুর এবং সরবরাহ বন্ধ করার ক্ষেত্রে নেতানিয়াহুকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন। হাউছিদের ওপর বোমাবর্ষণের ক্ষেত্রেও তিনি ইসরাইলের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তবে এখন তিনি ইয়েমেনে যুদ্ধবিরতি এবং গাজায় সমঝোতার চেষ্টা করছেন, যা নেতানিয়াহুর জন্য অস্বস্তিকর।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মার্কিন প্রোগ্রাম পরিচালক মাইকেল ওয়াহিদ হান্না বলেন, ট্রাম্প এখন ইসরাইলের স্বার্থ বিবেচনা না করেই ইরান ও ইয়েমেন বিষয়ে একতরফা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। অবশ্য এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনি ইস্যুতে তেমন কিছু দেখা যায়নি।

ইসরাইলি মিডিয়া জানিয়েছে, মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ তার আসন্ন ইসরাইল সফর বাতিল করেছেন। ১৩ মে ট্রাম্পের উপসাগরীয় সফরের একদিন আগে এই সফর শুরু হওয়ার কথা ছিল, যেখানে নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজের সাথে তার বৈঠক হওয়ার কথা ছিল।

মঙ্গলবার ট্রাম্প হাউছিদের সাথে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন। এতে ইরানের সাথে উত্তেজনা কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। কারণ হাউছিরা তেহরান থেকে সহায়তা পায়। ট্রাম্পের সফরের ঠিক আগে ওমানে চতুর্থ দফা মার্কিন-ইরান আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

এই সিদ্ধান্ত সৌদি আরবসহ আরব মিত্রদের সন্তুষ্ট করেছে। তারা ট্রাম্পের কাছে হামলা বন্ধের অনুরোধ করেছিল। এতে ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিটিও রক্ষিত হয়েছে। তবে ইসরাইল অস্বস্তিতে পড়েছে। কারণ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয় হাউছিদের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরের কাছে এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ওই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা কার্যকর করা হয়।

একজন মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা জানান, এই যুদ্ধবিরতির সাথে ‘আরামকো মোমেন্টের’ মিল রয়েছে, যা ২০১৯ সালে সৌদি তেল স্থাপনাগুলোতে হাউছিদের হামলায় ট্রাম্পের জবাব না দেয়ার সিদ্ধান্তকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

ট্রাম্পের একনিষ্ঠ মিত্র ও রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি যুদ্ধবিরতির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। হাউছিদের হামলার দিন হাকাবি বলেন, কেবল তখনই যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে যদি হতাহতদের মধ্যে মার্কিন নাগরিক থাকে। তিনি উল্লেখ করেন, প্রায় সাত লাখ মার্কিন-ইসরাইলি দ্বৈত নাগরিক রয়েছে।

রোববারের নির্ধারিত পারমাণবিক আলোচনা ও ইয়েমেন যুদ্ধবিরতির প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প গাজা উপত্যকার দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন। মানবাধিকারকর্মীরা সতর্ক করেছেন, ট্রাম্পের সফরের সময় গাজায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে।

কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের সিনিয়র ফেলো অ্যারন ডেভিড মিলার জানান, ট্রাম্প গাজা সফর এড়াতে চান না। সৌদিরা গাজায় কার্যকর কিছু না হলে ট্রাম্পকে চাপ দেবে। ফলে তিনি আরব নেতাদের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন, যারা ইরান ও হাউছিদের বিষয়ে খুশি, কিন্তু গাজা নিয়ে অসন্তুষ্ট।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্প গাজায় সাহায্য এবং মানবিক সমাধানের পথ খুঁজছেন। তবে একই সাথে ইসরাইলের কড়া অবস্থানকে সমর্থন করছেন।

ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য দূত স্টিভ উইটকফ জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদকে গাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেছেন। ইসরাইলি মিডিয়ার বরাতে জানা গেছে, ট্রাম্প গাজা যুদ্ধবিরতি নিয়ে নতুন পরিকল্পনা প্রকাশ করতে পারেন এবং সেখানে হামাসের ভবিষ্যৎ ভূমিকা নিয়ে বক্তব্য রাখতে পারেন।

মিডল ইস্ট আই জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ‘গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন’ নামের একটি অজানা অলাভজনক সংস্থার মাধ্যমে ছিটমহলে প্রবেশের চেষ্টা করছে। এ সংস্থার একটি ১৪ পৃষ্ঠার নথি সাহায্যকারী ও কূটনীতিকদের মাঝে প্রচার করা হয়েছে।

সূত্রটি আরো জানিয়েছে, কূটনীতিক ও ত্রাণকর্মীরা জানিয়েছেন যে ট্রাম্প প্রশাসন চাইছে, অবরুদ্ধ গাজায় মানবিক সাহায্য বিতরণের নিয়ন্ত্রণ মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হাতে থাকুক। আর নেতানিয়াহুর সরকার অনুমোদিত একটি মার্কিন বেসরকারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। এই পরিকল্পনার অধীনে ফিলিস্তিনিরা ১,৭৫০ কিলোক্যালরি খাবার পাবে, যার প্রতিদিনের খরচ দাতাদের জন্য এক ডলারেরও বেশি।

জাতিসঙ্ঘের এক কর্মকর্তা মিডল ইস্ট আইকে জানিয়েছেন, ট্রাম্প প্রশাসন জাতিসঙ্ঘ ও ত্রাণ সংস্থাগুলোর ওপর এই পরিকল্পনায় সম্মতি আদায়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। তবে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে প্রকল্পটি আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘন করতে পারে।

এই উদ্যোগ ইসরাইলের পক্ষ থেকে গাজায় জাতিসঙ্ঘের ভূমিকা কমিয়ে আনার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের দিকে অনেক দূর এগিয়ে নেবে। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত দুই আরব কূটনীতিক মিডল ইস্ট আইকে জানিয়েছেন, এটি কার্যত মানবিক সাহায্যের ধারা সামরিকীকরণ ও বেসরকারীকরণের পথে নিয়ে যাচ্ছে।

ফাউন্ডেশনটি একজন আমেরিকান নাগরিকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র কাতার, সৌদি আরব ও আমিরাতকে অর্থায়নে যুক্ত করার প্রত্যাশা করছে। তবে ইসরাইলের প্রকল্পের ওপর কঠোর নজরদারি থাকবে। কর্মকর্তারা আরো জানিয়েছেন, ইসরাইল এই প্রকল্পে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে কোনো ভূমিকায় দেখতে চায় না।

তবে এই পরিকল্পনা নেতানিয়াহুর অতি-ডানপন্থী জোটসঙ্গীদের সমালোচনার মুখে পড়েছে। তারা গাজা পুরোপুরি দখল এবং ফিলিস্তিনিদের বলপূর্বক বাস্তুচ্যুতির আহ্বান জোরদার করছে।

জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন গভির বলছেন, ‘আমাদের বন্দীরা যখন না খেয়ে আছে, তখন গাজার বাসিন্দাদের সাহায্য পাঠানো এক ধরনের বোকামি। এটি একটি নৈতিক ও কৌশলগত ভুল।’

এই মানবিক উদ্যোগ ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ আদর্শে বিশ্বাসী ট্রাম্পপন্থীদের সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ, তা স্পষ্ট নয়। এ বছরের শুরুতে তারা গাজা দখলের ট্রাম্পের আহ্বানের বিরোধিতা করে বিক্ষোভ করেছিল।

টাকার কার্লসন ও কংগ্রেসওম্যান মার্জোরি টেলর গ্রিনের মতো রক্ষণশীলরা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সম্পৃক্ততার কঠোর সমালোচনা করেছেন।

সৌদি আরবে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত চাস ফ্রিম্যান বলেছেন, ‘আমি মনে করি, মানুষ প্রশ্ন তুলবে যে ‘ইসরাইলের যুদ্ধের ফল হিসেবে গাজায় সাহায্য পরিচালনায় যুক্তরাষ্ট্র কেন জড়িত থাকবে?’

তিনি আরো বলেন, এবার উপসাগরীয় সফরে ট্রাম্পকে এমন কিছু বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে, যা ২০১৭ সালের সফরে ছিল না।

এই কূটনীতিক বলেন, ‘উপসাগরীয় দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করতো। এখন ক্ষমতার সেই ভারসাম্য আর নেই। এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প সফরে যাচ্ছেন। গাজা ও পশ্চিমতীরে ইসরাইলি কৌশলগুলোর প্রতি তার সম্মতি পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে।’

সৌদি পারমাণবিক চুক্তি আলোচনায়

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদি আরব ও ইসরাইলের মধ্যে ট্রাম্প-প্রস্তাবিত স্বাভাবিকীকরণ চুক্তি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি অনিশ্চিত।

আরব কর্মকর্তারা মিডল ইস্ট আইকে জানিয়েছেন, গাজায় যুদ্ধবিরতির অনুপস্থিতিতে রিয়াদ ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে এমনভাবে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে স্বাভাবিকীকরণ ও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের অগ্রগতি আটকে রাখা যায়।

তবে ট্রাম্প মনে করছেন না যে তাকে নেতানিয়াহুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তার জ্বালানি সচিব ক্রিস রাইট জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে বাণিজ্যিক পারমাণবিক বিদ্যুৎ খাত গড়ে তুলতে সহায়তা করতে চায়। এ নিয়ে ইতোমধ্যেই অগ্রগতি হয়েছে।

সাবেক এক সিনিয়র মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ সফরের আগে ব্যবসায়ীদের জানিয়েছে, তারা সৌদি আরবের সাথে এক বিলিয়ন ডলারের পারমাণবিক শক্তি চুক্তির পথে এগোচ্ছে—যা ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সঙ্গে যুক্ত নয়। এটি একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। কারণ রিয়াদকে স্বাভাবিকীকরণে প্ররোচিত করতে যুক্তরাষ্ট্র যে তিনটি মূল প্রস্তাব ব্যবহার করছিল, এটি তার একটি সরিয়ে দিচ্ছে।

যদিও আলোচনাগুলো এখনো শেষ হয়নি, স্বাভাবিকীকরণ ছাড়া পারমাণবিক প্রযুক্তি বিক্রির সম্ভাবনা রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহামকে উদ্বিগ্ন করেছে। তিনি বাইডেন প্রশাসনের পক্ষে স্বাভাবিকীকরণ আলোচনা এগিয়ে নিচ্ছিলেন।

গ্রাহাম এক্সবার্তায় লিখেছেন, ‘আমি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে চাই, যদি প্রস্তাবিত চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ না থাকে, তাহলে আমি কখনোই সৌদি আরবের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি বা এর অন্য কোনো অংশকে সমর্থন করব না।’

তবে ট্রাম্প প্রশাসন ইতোমধ্যে রিয়াদের কাছে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি দ্রুততর করতে প্রস্তুত, যার মধ্যে সম্ভাব্য এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানও রয়েছে। এটিও ছিল সেই দর কষাকষির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন কেবল একটি মার্কিন-সৌদি প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রতিশ্রুতি বাকি রয়েছে—যা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি এবং যার জন্য সিনেট অনুমোদন প্রয়োজন। এটি রিয়াদকে স্বাভাবিকীকরণের বিনিময়ে দেয়া হতে পারে।

অতএব, ইয়েমেন থেকে শুরু করে পারমাণবিক প্রযুক্তি পর্যন্ত—ট্রাম্প স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছেন নেতানিয়াহুকে যে উপসাগরীয় অঞ্চলে তার দ্বিতীয় অভিষেক তিনি ব্যর্থ হতে দেবেন না।

সূত্র : মিডল ইস্ট আই

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top