গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বিমান হামলার সময় বিস্ফোরিত না হওয়া প্রায় ৩,০০০ বোমা এখন ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালে পরিণত হয়েছে। ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম দ্য মার্কার জানিয়েছে, হামাসের সশস্ত্র শাখা আল-কাসসাম ব্রিগেড এই অবিস্ফোরিত বোমাগুলো থেকে ইম্প্রোভাইজড বিস্ফোরক ডিভাইস (IED) তৈরি করছে এবং তা ইসরাইলি বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণে ব্যবহার করছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে ইসরাইল যে গোলাবারুদ ফেলে গেছে, তার মধ্যে ২০% পর্যন্ত বিস্ফোরিত হয়নি। এই অবস্থা গাজায় অবিস্ফোরিত অস্ত্রের ঝুঁকি বাড়িয়েছে, যা নিয়ে বহুবার মানবাধিকার সংস্থা ও স্থানীয় সংগঠনগুলো সতর্ক করেছে।
পুনর্ব্যবহারের বিপদ ও শক্তি
ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর তদন্তে জানা গেছে, জানুয়ারিতে গাজায় একটি ইসরাইলি ট্যাংকসহ কয়েকটি সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয় হামাসের তৈরি বড় ধরনের বিস্ফোরণে, যেগুলোর কাঁচামাল ছিল অবিস্ফোরিত বোমা। ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ ইসরাইল গাজায় ৪০,০০০-এর বেশি বিমান হামলা চালায়। জাতিসংঘের মাইন অ্যাকশন সার্ভিস (UNMAS) অনুমান করেছে, এসব হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রের মধ্যে ৫% থেকে ১০% বিস্ফোরিত হয়নি।
দ্য মার্কার আরও জানায়, ২০২৫ সালের শুরুতে ইসরাইলি সেনাবাহিনী গাজায় অন্তত ৩,০০০ অবিস্ফোরিত বোমার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল। প্রতিটি বোমার দাম ২০,০০০ থেকে ৩০,০০০ মার্কিন ডলারের মধ্যে, অর্থাৎ এইসব অবিস্ফোরিত বোমা থেকে কয়েক মিলিয়ন ডলারের বিস্ফোরক পদার্থ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “এই অবিস্ফোরিত বোমাগুলি কার্যত একটি পাইপলাইনে পরিণত হয়েছে, যার মাধ্যমে ইসরাইল অনিচ্ছাকৃতভাবে হাজার হাজার টন বিস্ফোরক হামাসের হাতে তুলে দিয়েছে।”
হামাসের অস্ত্রের সংকটের মধ্যে এই পুনর্ব্যবহৃত কাঁচামালই তাদের যোদ্ধাদের হাজার হাজার বিস্ফোরক তৈরিতে সহায়তা করছে, যা ইসরায়েলি সেনাদের ওপর হামলায় ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে ইসরাইলি সেনাদের হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে।
ত্রুটিপূর্ণ ফিউজ এবং ইসরাইলি অস্ত্রের ব্যর্থতা
ইসরাইলি অস্ত্রের এই ব্যর্থতার পেছনে প্রযুক্তিগত ত্রুটি ও অস্ত্র নিক্ষেপের তীব্র গতিকে দায়ী করা হয়েছে। সেনাবাহিনী ফিউজ সরবরাহের ঘাটতির কারণে পুরোনো এবং আমদানিকৃত ফিউজ ব্যবহার করছে, যার কিছু আবার কয়েক দশক পুরোনো। ফলে, যেখানে আগে বোমার গড় ব্যর্থতার হার ছিল ২%, সেখানে এখন গাজায় ব্যবহৃত কিছু বোমার ক্ষেত্রে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০% পর্যন্ত।
এই বোমাগুলোর ব্যবহার পদ্ধতি তুলনামূলকভাবে সহজ। আল-কাসসাম ব্রিগেডের সদস্যরা কখনো বোমা কেটে বিস্ফোরক সংগ্রহ করে ধাতব পাত্রে রাখে, আবার কখনো সেগুলো অবিকল অবস্থায় রেখেই বিস্ফোরণের জন্য ধাতব তার যুক্ত করে। এই প্রক্রিয়ায় দুর্ঘটনা ঘটার ঝুঁকি থাকলেও, হামাস তা মেনে নিতে প্রস্তুত বলেই প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
ইসরাইলি সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া ও বাস্তবতা
এই প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা গাজা উপত্যকায় অবিস্ফোরিত অস্ত্রের হুমকি মোকাবেলায় সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে এবং “মাত্র একটি ছোট শতাংশ” অস্ত্র বিস্ফোরণে ব্যর্থ হয়েছে। তবে বাস্তবে, গাজার সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা এই অবিস্ফোরিত বোমাগুলো বেসামরিক নাগরিকদের জন্য বড় হুমকি হয়ে রয়ে গেছে। এগুলোর অপসারণে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সম্পদের অভাবে প্রতিনিয়ত প্রাণহানি, আহত ও স্থায়ী অক্ষমতার ঘটনা ঘটছে।
নৃশংসতার মানবিক খরচ
২০২৩ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া ইসরাইলি হামলায় এখন পর্যন্ত ৫২,৬০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ইতোমধ্যে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও তার প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।
গাজা উপত্যকার ওপর চালানো এই যুদ্ধের জন্য ইসরাইল আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগের মুখোমুখিও হয়েছে।
সূত্র : আনাদোলু