ইসরাইল, গাজা

ইসরাইলের ফিলিস্তিনি বহিষ্কারের নতুন পরিকল্পনার ঐতিহাসিক পটভূমি

ইসরাইলি সরকার সম্প্রতি গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের তথাকথিত স্বেচ্ছায় অভিবাসন পরিচালনার জন্য একটি নতুন সংস্থা প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছে। এই সংস্থায় ইসরাইলের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও নিরাপত্তা সংস্থার প্রতিনিধিরা রয়েছেন। তারা আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর সাথে সমন্বয় করবে। সংস্থার মূল লক্ষ্য হলো ইসরাইলের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের তৃতীয় দেশে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা।

ইসরাইলি সংসদের বামপন্থী সদস্য অফার কাসিফ এই নতুন উদ্যোগকে ১৯৩৮ সালে নাৎসি জার্মানির ইহুদি অভিবাসন ব্যুরোর সাথে তুলনা করেছেন, যা তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। ডানপন্থী দল ওটজমা ইয়েহুদিত কাসিফের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে এবং তার বক্তব্যকে উগ্রবাদের সমর্থন বলে অভিহিত করেছে।

এদিকে, মিসর ও জর্ডান ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুকে গ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ করায় ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র বিকল্প গন্তব্য হিসেবে সুদান, সোমালিয়া, সোমালিল্যান্ড, রুয়ান্ডা ও চাদের সাথে আলোচনা করেছে। উল্লেখযোগ্যভাবে যুদ্ধ শুরুর মাত্র এক সপ্তাহ পর ১৩ অক্টোবর ২০২৩-এ ইসরাইলি গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়ের একটি নথিতে সিনাই, স্পেন, গ্রীস এবং কানাডাকে সম্ভাব্য বহিষ্কার গন্তব্য হিসেবে প্রস্তাব করা হয়।

তবে এই পরিকল্পনা নতুন নয়। ১৯৩০-এর দশকে ব্রিটিশ সরকারের পিল কমিশনের প্রতিবেদন অনুসরণে ১৯৩৭ সালে প্রথম ইহুদিবাদী ‘জনসংখ্যা স্থানান্তর কমিটি’ গঠিত হয়েছিল। এরপর ১৯৪১ এবং ১৯৪৮ সালে আরো দু’টি বহিষ্কার কমিটি গঠন করা হয়। এই পরিকল্পনাগুলোর ভিত্তিতে ১৯৪৭-৪৯ সালে ইসরাইল তিন-চতুর্থাংশের বেশি ফিলিস্তিনিকে বহিষ্কার করে।

এই প্রসঙ্গে কেউ কেউ ইসরাইলি পরিকল্পনার সাথে নাৎসি জার্মানির মাদাগাস্কার পরিকল্পনার তুলনা করছেন, যদিও ঐ পরিকল্পনার উৎস ছিল লন্ডন-ভিত্তিক জায়নিস্ট সংগঠন ফ্রিল্যান্ড লীগ-এর ১৯৩৬ সালের প্রস্তাব। তারা আফ্রিকা, ওশেনিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকায় ইহুদি উপনিবেশ স্থাপনের চিন্তাভাবনা করেছিল, যার মধ্যে মাদাগাস্কার অন্যতম প্রধান গন্তব্য ছিল।

ফ্রিল্যান্ড লীগ ফরাসি ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ এবং পোল্যান্ডের ইহুদি-বিরোধী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে যৌথভাবে এই পরিকল্পনায় কাজ করে। সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বর্তমান ইসরাইলি পদক্ষেপকে অনেকেই উদ্বেগজনক ও বিপজ্জনক নজির হিসেবে দেখছেন।

মাদাগাস্কার পরিকল্পনা

১৯৩০-এর দশকে ইহুদি উপনিবেশ স্থাপনের জন্য আফ্রিকার মাদাগাস্কার দ্বীপকে সম্ভাব্য গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই প্রকল্পে জড়িত ছিল ফ্রিল্যান্ড লীগ, পোলিশ সরকার, ফরাসি ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ এবং নাৎসি জার্মানির নেতারাও। ইউরোপীয় ইহুদিদের নির্বাসন ও উপনিবেশ স্থাপনের এই পরিকল্পনায় অংশ নেয় পোলিশ ইহুদি নেতারা, জেডিসি (Jewish Joint Distribution Committee) এবং ইহুদি ত্রাণ সংস্থা।

১৮৮৫ সালেই জার্মান ইহুদি-বিরোধী পল ডি লাগার্দ ইউরোপীয় ইহুদিদের মাদাগাস্কারে স্থানান্তরের ধারণা দেন। ১৯৩৭ সালে পোলিশ সরকারের মদদে একটি অনুসন্ধান দল দ্বীপে পাঠানো হয়, যার মধ্যে ছিলেন পোলিশ ইহুদি সলোমন ডাইক, লিওন অল্টার এবং ক্যাথলিক সামরিক কর্মকর্তা মিজিস্লা লেপেকি। তারা দ্বীপে তিন মাস অবস্থান করে উপনিবেশ স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই করেন।

যদিও স্থানীয় জনগণের প্রতিরোধ ও মাদাগাস্কারের সংবাদমাধ্যমে ইহুদি আক্রমণ নিয়ে উদ্বেগ দেখা দেয়, ফরাসি ও পরে ব্রিটিশ সরকার এই পরিকল্পনায় আগ্রহ দেখায়। ১৯৪০ সালে ফ্রান্স নাৎসিদের হাতে পতনের পর হিটলার ও হিমলারের অনুমোদনে মাদাগাস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। অ্যাডলফ আইচম্যানের নেতৃত্বে চার মিলিয়ন ইহুদিকে সেখানে পাঠানোর পরিকল্পনা তৈরি হয়, যেখানে তারা জার্মান গভর্নরের অধীনে স্বায়ত্তশাসিত জীবনযাপন করবে।

এই সময় ফিলিস্তিনের জায়নবাদী স্টার্ন গ্যাং পর্যন্ত নাৎসিদের সাথে এই পরিকল্পনায় সহযোগিতা করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ বাহিনী মাদাগাস্কার দখল করলে এবং নাৎসিরা ইহুদি গণহত্যায় মনোনিবেশ করলে এই পরিকল্পনার অবসান ঘটে।

এই ইতিহাস উপনিবেশবাদ ও গণবহিষ্কারের বৃহৎ ধারা অনুসরণ করে। যেমন ১৮৩০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ান রিমুভাল অ্যাক্ট এর অধীনে আদিবাসীদের বিতাড়ন, আলজেরিয়ায় ফরাসি নীতিমালা, অথবা আফ্রিকায় পর্তুগিজ উপনিবেশবাদ সবই ইঙ্গিত করে কিভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্র ও বর্ণবাদী শাসকগোষ্ঠী মানবিক বিবেচনার তোয়াক্কা না করে জনগোষ্ঠী স্থানান্তরের পরিকল্পনা করে।

আজও ইসরাইল ও তার মিত্ররা চাদ, সোমালিয়া, সুদান কিংবা রুয়ান্ডার মতো দেশকে ফাঁকা জমি হিসেবে দেখে, যেন বিতাড়িত জনগোষ্ঠী সেখানে পুনর্বাসিত হতে পারে যেমনটা একদিন মাদাগাস্কারের ক্ষেত্রেও পরিকল্পিত হয়েছিল।

সূত্র : মিডল ইস্ট আই

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top