ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, ট্রাম্প, হরমুজ প্রণালী,

ইসরাইলের বিরুদ্ধে সঙ্ঘাতে ইরানের সামনে কী কী বিকল্প আছে

গত তিন দিনে ইসরাইলের ধারাবাহিক বিমান হামলায় ২৪০ জনের বেশি ইরানি নাগরিক নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন দেশের গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ সামরিক নেতৃত্ব। এই পরিস্থিতিতে ইরান কেবল প্রতিরোধেই ক্ষান্ত থাকেনি। বরং পাল্টা আঘাতে তেল আবিব ও হাইফার মতো ইসরাইলের বৃহৎ শহরগুলোতে ধ্বংসাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এটি মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত পরিবেশে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

তবে এই সঙ্ঘাতে উভয় পক্ষের প্রকৃত ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ এবং কোন কোন স্থানে আঘাত লেগেছে, তা নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ যুদ্ধকালীন প্রচারণা ও তথ্য যুদ্ধ এর মধ্যে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে, ইরান ও ইসরাইলের হাতে এখনো কতটা গোলাবারুদ এবং ক্ষেপণাস্ত্র মজুত রয়েছে, অথবা তারা এই সঙ্ঘাত কতদিন টানতে পারবে, তাও অনিশ্চিত।

তবে এটুকু নিশ্চিত যে ইরান মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির অধিকারী। তার হাতে রয়েছে নানা ধরনের, বিভিন্ন রেঞ্জ ও গতির হাজার হাজার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এসব অস্ত্রের সাহায্যে ইরান কয়েক সপ্তাহ ধরে ইসরাইলকে আক্রমণ চালিয়ে যেতে পারে; বিশেষ করে গাজা, লেবানন ও ইয়েমেন থেকে আসা হামলার সাথে সমন্বয় ঘটিয়ে। ইরান তার ‘হজ কাসেম’ নামের উন্নত প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্রও ব্যবহারে এনেছে, যা ইসরাইলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এড়িয়ে গিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে সাফল্যের সাথে আঘাত হেনেছে।

যদিও এই উন্নত ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা সীমিত, তবে মানসম্পন্ন অস্ত্র ও বিপুল সংখ্যক ড্রোন মজুদের কারণে ইরান তাৎক্ষণিকভাবে ইসরাইলকে সামরিকভাবে বড় ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ এড়ানোর কৌশল

ইরানের হামলার প্রেক্ষিতে ইসরাইল ‘আয়রন ডোম’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রও আংশিকভাবে সহায়তা করছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়ে দিয়েছেন, ইসরাইল-ইরান সঙ্ঘাতে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি পক্ষ নয়। তবে যদি ইরান মার্কিন সামরিক ঘাঁটি বা স্বার্থে হামলা চালায়, তবে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ।

এই কারণেই ইরান এখন পর্যন্ত মার্কিন ঘাঁটিগুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানাতে চায় না। পারস্য উপসাগরের কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব বা তুরস্কে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালানো ইরানের কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে বিপজ্জনক হতে পারে। একইসাথে এই দেশগুলোকে সম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবেও ইরান বিবেচনা করছে।

হরমুজ প্রণালী : তেহরানের একটি শক্তিশালী কার্ড

অন্যদিকে, ইরানের সামনে একটি বড় কৌশলগত বিকল্প হলো হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা। এই প্রণালী দিয়ে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ ব্যারেল তেল পরিবাহিত হয়, যা বিশ্ব জ্বালানি বাজারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যেই তেলের দাম ৭৮ ডলারে উঠেছে, যা যুদ্ধ দীর্ঘ হলে ১০০ ডলার পার হতে পারে বলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। কাজেই হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুমকি ইরানিদের হাতে একটি শক্তিশালী চাপ সৃষ্টিকারী কৌশল হিসেবে থাকছে।

সঙ্ঘাতের অবসানের সম্ভাব্য রূপরেখা

ইরান জানে, এই সঙ্ঘাত বেশি দিন টানলে তা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের যৌথ শক্তির বিরুদ্ধে এক আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। এতে তাদের অর্থনীতি ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে। তেহরান ইতোমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়েছে, যদি ইসরাইল হামলা বন্ধ করে, তবে ইরানও প্রতিক্রিয়া বন্ধ করবে। একইসাথে আমেরিকার সাথে পরমাণু আলোচনায় ফিরতে প্রস্তুত বলেও জানিয়েছে তারা।

তবে এর চূড়ান্ত নির্ভরতা থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। ট্রাম্প প্রশাসনের বক্তব্যও এক্ষেত্রে একাধিকবার পরিবর্তিত হয়েছে। একদিকে যুদ্ধ বন্ধের ডাক, অন্যদিকে ইরানকে সরাসরি হুমকি। ইরান মনে করে, ট্রাম্প একজন অস্থির ও অবিশ্বাসযোগ্য নেতা, যার উপর নির্ভর করা যায় না। তার নেতৃত্বে আমেরিকা ইসরাইলি আগ্রাসন সম্পর্কে জেনেও ইরানকে ধোঁকা দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে তেহরান।

সব মিলিয়ে, ইরানের সামনে এখন কয়েকটি বিকল্প স্পষ্ট। এক, প্রতিরোধ ও পাল্টা হামলা চালিয়ে যাওয়া; দুই, হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুমকি কার্যকর করা; তিন, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় একটি সম্মানজনক চুক্তির মাধ্যমে সঙ্ঘাত থেকে বেরিয়ে আসা।

তবে পরিস্থিতির গতিপথ কোনদিকে যাবে, তা নির্ভর করবে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর।

সূত্র : আল জাজিরা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top