যুদ্ধ-পরবর্তী ইসরাইলের শ্রমবাজারে বিরাট ধস

ইসরাইলের শ্রমবাজারে বিরাট ধস

ইসরাইলে চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দেশটির শ্রমবাজারে চরম বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ইসরাইলি শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের উত্তরাঞ্চল ও দুর্বল শ্রেণিগুলোর মধ্যে কর্মসংস্থানের হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।

দক্ষিণের তুলনায় উত্তর অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত

ক্যালকালিস্ট জানায়, ২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে উত্তর সীমান্তের ০-৩.৫ কিলোমিটার এলাকার শহরগুলোতে যেখানে কর্মসংস্থানের হার ছিল ৮২ শতাংশ, ২০২৪ সালের একই সময়ে তা কমে হয়েছে ৬৭ শতাংশ—১৫ শতাংশ পয়েন্টের পতন। অন্যদিকে গাজা সীমান্তবর্তী ০-৭ কিলোমিটার এলাকার শহরগুলোতে এই হার কমেছে ৮৬ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ—মাত্র ৬ শতাংশ পয়েন্ট।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, উত্তরাঞ্চলে এই চরম পতনের পেছনে রয়েছে জোরপূর্বক স্থানান্তর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা ভেঙে পড়া, যা কার্যত ওই এলাকার কর্মপরিবেশকে ধ্বংস করেছে।

যুদ্ধ-পূর্ব অবস্থা থেকেই উত্তরের ভঙ্গুরতা

যুদ্ধ শুরুর আগেই দক্ষিণাঞ্চলের তুলনায় উত্তরের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল দুর্বল। যেমন গাজা সীমান্তবর্তী শহরগুলোতে কর্মসংস্থানের হার ছিল ৯১ শতাংশ, কলেজ শিক্ষার হার ৩২ শতাংশ এবং গড় মজুরি ছিল ১৩ হাজার ৪০০ শেকেল (প্রায় ৪,০১৩ ডলার)। এর বিপরীতে, উত্তরাঞ্চলের উচ্ছেদকৃত শহরগুলোতে কর্মসংস্থানের হার ছিল মাত্র ৭৮ শতাংশ, কলেজ শিক্ষার হার ২৮ শতাংশ আর গড় মজুরি ১২,১৫০ শেকেল (প্রায় ৩,৬৩৮ ডলার)।

ক্যালকালিস্ট মন্তব্য করেছে, ‘এই কাঠামোগত বৈষম্য যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই উত্তরের বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক পতনের ঝুঁকিতে ফেলে দেয়।’

তরুণদের মধ্যে বিপর্যয়কর হ্রাস

প্রতিবেদনের সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হচ্ছে ২৫-৪০ বছর বয়সী উত্তরাঞ্চলীয়দের মধ্যে কর্মসংস্থানের হারের তীব্র পতন। ২০২২ সালে এই হার ছিল ৮৭ শতাংশ, যা ২০২৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬৬ শতাংশ।

রিজার্ভ সার্ভিসে ডাকা পুরুষদের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের হার কমেছে ৩.৩ শতাংশ পয়েন্ট, যা ৪১-৬৬ বছর বয়সীদের তুলনায় চার গুণ বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘমেয়াদি রিজার্ভ ডিউটির ফলে তাদের নিয়মিত চাকরির যোগ্যতা ও স্থায়িত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।

রিজার্ভ ডিউটির প্রভাব তাদের স্ত্রীর কর্মসংস্থানের ওপরও পড়েছে। যেসব নারীর স্বামীরা রিজার্ভ সার্ভিসে আছেন, তাদের মধ্যে কর্মসংস্থানের হার ১ থেকে ২.৩ শতাংশ পয়েন্ট কমে গেছে এবং পূর্ণ-সময়ের কাজের হার কমেছে ২ থেকে ৫ শতাংশ পয়েন্ট।

ইসরাইলের শ্রমমন্ত্রী ইয়াভ বেন-তজুর বলেন, ‘নারীদের জন্য আইনি সুরক্ষা থাকার ফলে আমরা গুরুতর পতন থেকে বেঁচে গেছি। তবে এর প্রভাব এখনো স্পষ্ট।’

আরব নাগরিকদের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়

আরব নাগরিক, বিশেষত আরব পুরুষরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০২৩ সালের শুরুতে আরব পুরুষদের কর্মসংস্থানের হার ছিল ৭৭.৯ শতাংশ, যা ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ কমে দাঁড়িয়েছে ৭৫.৫ শতাংশ।

আরো ভয়াবহ হচ্ছে সাক্ষরতার হারসংক্রান্ত তথ্য। আন্তর্জাতিক BIAAAC পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী, ২০১৪ সালে যেখানে আরব প্রাপ্তবয়স্কদের ৪৬ শতাংশ পড়ার অসুবিধায় ভুগছিলেন, ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ শতাংশ। তরুণ আরব পুরুষদের মধ্যে এই হার আরো বেশি- ৭৪ শতাংশ।

সূত্রটি আরো জানিয়েছে, এই শিক্ষা-সঙ্কট আরব যুব সমাজের শ্রমবাজারে প্রবেশকে আরো কঠিন করে তুলছে এবং নিরাপত্তা সঙ্কটের প্রতিটি ধাক্কা পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করছে।

ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ ইহুদি তরুণদের মধ্যেও বৈষম্য

হারেদিম (চরমপন্থী ধর্মীয় ইহুদি) এবং হারেদি-বহির্ভূত তরুণদের মধ্যে পড়ার দক্ষতার বড় ব্যবধান রয়েছে। হারেদি তরুণদের ৬০ শতাংশ দুর্বল পড়ার দক্ষতায় ভোগে, যেখানে ধর্মবিশ্বাসী ইহুদিদের মধ্যে এই হার ৩৭ শতাংশ।

প্রযুক্তি খাতের উত্থান ও স্থবিরতা

গত এক দশকে প্রোগ্রামিং খাত সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল খাত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ২০১২ সালে যেখানে কর্মীর সংখ্যা ছিল ২.৯ শতাংশ, ২০২৪ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৫.১ শতাংশ। তবে ২০২৩ সাল থেকে এই খাতেও স্থবিরতা এসেছে।

অন্যদিকে, স্টোর সেলস অ্যাসোসিয়েট পেশায় কর্মী সংখ্যা কমে গেছে- ২০১২ সালের ৪.২ শতাংশ থেকে ২০২৪ সালে ৩.১শতাংশ। একে ক্যালকালিস্ট দায়ী করেছে দ্রুত ই-কমার্সে স্থানান্তরের জন্য।

প্রতিবেদনের উপসংহারে ক্যালকালিস্ট উল্লেখ করে যে শ্রমবাজারে পেশাগত ও সামাজিক বৈষম্য আরো বিস্তৃত হচ্ছে, নিরাপত্তা সঙ্কট প্রান্তিক গোষ্ঠীকে আরো দুর্বল করছে এবং সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সামগ্রিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা অনুপস্থিত।

সংবাদপত্রটি সতর্ক করেছে, ‘উত্তরে যা ঘটছে তা শুধুই সাময়িক কর্মসংস্থান হ্রাস নয়। বরং এটি কর্মসংস্থান ও সামাজিক স্থিতিশীলতার স্তম্ভগুলোর সম্পূর্ণ পতন। এই ব্যবধান যদি দূর না করা হয়, তবে এর প্রভাব বহু প্রজন্মব্যাপী বিস্তৃত হবে এবং উত্তর ইসরাইল এক বিপজ্জনক বিনিয়োগবিরোধী অঞ্চলে পরিণত হবে।’

সূত্র : আল জাজিরা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top