ইসরাইলের ভেতরেই বাজছে ভাঙনের সুর

ইসরাইলের ভেতরেই বাজছে ভাঙনের সুর

ইসরাইলের ভেতরেই বাজছে ভাঙনের সুর। ইহুদিবাদ এখন দুটি বিপরীত রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিভক্ত। এই বিভাজন আজ আর কেবল মতাদর্শিক নয়; এটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। একদিকে ‘তেল আবিব রাষ্ট্র’ একটি ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিকতাবাদী, উদার মধ্যবিত্ত শ্রেণি; অন্যদিকে অধিকৃত পশ্চিমতীরকে কেন্দ্র করে ‘জুডিয়া ও সামেরিয়া রাজ্য’ এক ধরনের ধর্মীয়-মেসিয়ানিক রাষ্ট্রিক কল্পনা।

নেতানিয়াহু যেভাবে ইসরাইলের একচ্ছত্র নেতা হয়ে ওঠেন

কেন ইসরাইলের ভেতরেই বাজছে ভাঙনের সুর

এই মাসের শুরুতে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ওয়াশিংটন সফর শেষ করে ফিরলে সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গ্যান্টজ ইরানের উপর হামলার সমর্থনে একটি প্রচারণা শুরু করেন। এই পদক্ষেপ এমন এক সময়ে আসে যখন গাজায় দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ এবং রিজার্ভ বাহিনীর উপর অতিরিক্ত চাপ ইসরাইলি সমাজে অভূতপূর্ব সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। সংসদের বিরোধীদল নেতানিয়াহুর ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ কৌশলের বাস্তবতা অস্বীকার করলেও, ইরানের উপর সম্ভাব্য হামলা গোটা অঞ্চলকে বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেবে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। একইসাথে, সিরিয়ায় ইসরাইলের সামরিক হস্তক্ষেপ দেশটিকে আরেকটি জলাভূমিতে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে ইসরাইলের ভেতরে বাজছে ভাঙনের সুর।

নেতানিয়াহুই ইসরাইলের শত্রু, তাকে বন্দী করা উচিত : সাবেক সেনাপ্রধান

এই কৌশলগত ও সামরিক জটিলতা ইসরাইলের সামরিক সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করছে। তার চেয়েও গভীরে, একধরনের পরিচয় সংকট দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে — একদিকে “তেল আবিব রাষ্ট্র”, অন্যদিকে অধিকৃত অঞ্চলের কেন্দ্রিক ধর্মীয়-জাতীয়তাবাদী কল্পিত রাষ্ট্র। এই বিভেদ সম্প্রতি চরমে পৌঁছেছে: একজন শিন বেট কর্মকর্তা গোপন তথ্য ফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন, যা একটি নজিরবিহীন ঘটনা। অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ এই সপ্তাহে যুদ্ধ মন্ত্রিসভার বৈঠকে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান, কারণ শিন বেট প্রধান রোনেন বার সেখানে উপস্থিত থাকবেন।

একই সময়ে, শিন বেট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নিরাপত্তা তথ্য ফাঁস এবং কাহানিস্ট কর্মীদের পুলিশের ভিতরে অনুপ্রবেশ নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যেও বিভাজন তৈরি হয়েছে। পুলিশের ওপর একজন মেসিয়ানিক-ডান জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণ থাকায় অধিকৃত পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা রোধে তারা নিষ্ক্রিয়, অন্যদিকে শিন বেট রাষ্ট্রযন্ত্র এবং নেতানিয়াহুবিরোধীদের সঙ্গে অবস্থান নিয়েছে। এই বিভক্তি মিডিয়াতেও প্রতিফলিত হচ্ছে।

গাজা যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জন করা অসম্ভব : ইসরাইলি সেনাপ্রধান

নেতানিয়াহুর ডানপন্থী জোটের অভ্যন্তর থেকেও এখন সমালোচনা উঠে আসছে। সাবেক মিত্ররা—যেমন মোশে ইয়ালন, ড্যান মেরিডর ও ড্যান হালুৎজ—তাদের পূর্বের অবস্থান থেকে সরে এসে স্পষ্টতই নেতানিয়াহুর দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করছেন। সেনাপ্রধান থাকাকালে যিনি অধিকৃত পশ্চিম তীরে মারাত্মক সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিলেন, সেই ইয়ালন এক প্রাইম-টাইম সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি আশা করেন না যে ইসরাইল গাজায় “শিশুদের হত্যা করার জন্য” সৈন্য পাঠাবে। তার স্বীকারোক্তি ছিল স্পষ্ট: ইসরাইল উত্তর গাজায় একটি জাতিগত নির্মূল অভিযানে নিয়োজিত।

গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে ইসরাইলিদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মালদ্বীপ

সাবেক বিচারমন্ত্রী ড্যান মেরিডর ইসরাইলের রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান বর্ণবাদের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন এবং মনে করিয়ে দেন, এক সময় রাব্বি মেইর কাহানার দলকে নির্বাচন থেকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল তাদের বর্ণবাদী প্ল্যাটফর্মের জন্য। তিনি শিন বেটকে অধিকৃত পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারীদের গণহত্যা তদন্ত করার আহ্বান জানান। তার মতে, গাজা এবং পশ্চিম তীরের অধিগ্রহণ জনসংখ্যার বাস্তবতার কারণে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইসরাইলি বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান ড্যান হালুৎজ গাজা যুদ্ধের বিরোধিতা করে বলেন, এটি ঘৃণা আরও গভীর করবে এবং শত্রুদের আরও শক্তিশালী করে তুলবে। হারেটজ-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন, তার সন্তান ও নাতিপুতিরা ইসরাইল ত্যাগ করতে পারে, কারণ নেতানিয়াহুর সামাজিক প্রকল্প তেল আবিবের উদার জীবনধারা ও দখলদারিত্বের ভারসাম্যকে ভেঙে দিচ্ছে।

এই সাবেক কর্মকর্তারা বুঝতে পারছেন, ইসরাইলি বামপন্থীদের অনেকেই এখনো যা অস্বীকার করেন—ডানপন্থী ইহুদিবাদ কেবল যুদ্ধের জন্য নয়, বরং সাংস্কৃতিক আধিপত্য ও আদর্শিক পুনর্গঠনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বামপন্থীরা কোনও কার্যকর বিকল্প দিতে পারছে না, কিন্তু মেসিয়ানিক ডানপন্থীরা সুপরিকল্পিত একটি দীর্ঘ আদর্শিক যুদ্ধের ভিত নির্মাণ করছে, যা রাষ্ট্রের পরিচয় পুনর্গঠনের দিকে এগোচ্ছে।

ইসরাইলি সেনাবাহিনীতে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ: এক সপ্তাহে ছয়টি বিদ্রোহমূলক বিবৃতি

গাজা যুদ্ধের সময়, ইসরাইলের একমাত্র সাফল্য হচ্ছে গণহত্যার সহিংসতা চালিয়ে স্বাভাবিকতা বজায় রাখা। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি এবং লেবাননের নাগরিক নিহত হলেও ইসরাইলি সমাজে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত। হেগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগ, বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ ও বয়কটের মাঝেও ইসরাইলি জনগণ প্রায় নির্বিকার।

আসল সমস্যা তথ্যের অজ্ঞতা নয়, বরং বিচ্ছিন্নতার মানসিকতা। তাৎক্ষণিক তথ্যপ্রবাহ থাকা সত্ত্বেও, ইসরাইলিরা স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত। গাজা বা বৈরুত থেকে গোলাবর্ষণের শব্দ শোনা গেলেও তারা তাদের শহরের আরাম-আয়েশ থেকে বিচ্যুত হয় না। “আমরা জানতাম না” বলে আর রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়, কারণ ইসরাইলি সৈন্যরা নিজেরাই যুদ্ধের ভিডিও চিত্র ধারণ ও শেয়ার করছে। তাই জানা সত্ত্বেও অবহেলার এই সংস্কৃতিই মূলত বিপদের উৎস।

নেতানিয়াহুর একসময়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা এখন যে সমস্যাটি তুলে ধরছেন, তা হলো সেই ভারসাম্যের হুমকি, যা একসময় ইসরাইলিদের দখলদারিত্ব ও সমৃদ্ধি একইসাথে উপভোগের সুযোগ দিয়েছিল। এই ভারসাম্যের কারণেই ইসরাইলি জনসাধারণ যুদ্ধের মধ্যেও সৈন্য হিসেবে কাজ করতে স্বস্তি বোধ করত। যুদ্ধ শেষে সৈন্যরা ফিরে আসে স্পা ভাউচার, জিম ডিসকাউন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়ার আনন্দঘন পোস্ট নিয়ে—যেখানে গাজার পরিপ্রেক্ষিতে হঠাৎ প্যারিসের জীবনে প্রবেশ ঘটে।

কিন্তু এই ভারসাম্য এখন হুমকির মুখে। মেসিয়ানিক ডানপন্থীরা একটি সামরিকায়িত, ধর্মীয় রাষ্ট্রীয় প্রকল্পে নিযুক্ত — যেখানে সীমাহীন আঞ্চলিক সম্প্রসারণ, প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও সাংস্কৃতিক রূপান্তর লক্ষ্য। অথচ এই প্রকল্পের জন্য অধিকাংশ ইসরাইলি প্রস্তুত নয়।

গাজা যুদ্ধে ইসরাইলি বাহিনীর ৭৮ হাজার সদস্য আহত

এই সংকটের কেন্দ্রে রয়েছে ইসরাইলের মধ্যবিত্ত শ্রেণী — বিশেষত তেল আবিবে কেন্দ্রীভূত শ্রেণী যারা ‘সেখানে দখল, এখানে উদারতা’ সূত্রে বসবাস করছিল। কিন্তু ২০০৫ সালের গাজা বিচ্ছিন্নতার পর থেকে, ডানপন্থীরা কৌশলগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ শহরে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন, সমাজে সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশ ও ক্ষমতার প্রতিষ্ঠানে দখল প্রক্রিয়া শুরু করে। ফলস্বরূপ, অধিকৃত পশ্চিম তীরের বিশৃঙ্খলা এখন ইসরাইলি অভ্যন্তরীণ সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে।

নেতানিয়াহুর সাবেক মিত্রদের শঙ্কা হলো, তেল আবিবের এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী, তাদের সম্পদ ও গতিশীলতার কারণে, সহজেই দেশ ত্যাগ করতে পারে। এর ফলে ইসরাইলের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে এর উদার ভাবমূর্তি চূর্ণ হবে।

সম্ভবত, এই সাবেক কর্মকর্তারা এখন কথা বলছেন কারণ তারা আর রাজনীতি বা সামরিক চাকরিতে ফিরে যেতে চান না। এর ফলে তারা তাদের অতীতের ভূমিকা নিয়ে খোলামেলা স্বীকারোক্তি দিতে পারছেন। তারা জানেন, নেতানিয়াহুর উত্থানে তাদের হাত ছিল, এবং সেই উত্তরাধিকার তাদের বহন করতে হবে।

ইসরাইল সম্পর্কে মার্কিনিদের অবস্থান

তবে তাদের সমালোচনার মাঝেও এক সুস্পষ্ট ব্যর্থতা রয়ে গেছে: তারা এখনও ফিলিস্তিনি মানবতাকে রাজনৈতিক ও নৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান দিতে পারেননি। তাদের চোখে ফিলিস্তিনিরা এখনও কেবল একটি পার্শ্ব গল্প। যতক্ষণ না ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও সাম্যের অধিকারের স্বীকৃতি ইসরাইলি জাতীয় নীতির নৈতিক ভিত্তি হয়ে ওঠে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই সমালোচকগণ বিকল্প নয়। তারা কেবল সেই ইসরাইলের জন্য শোক প্রকাশ করছেন, যা একসময় তাদের পরিচিত ছিল।

সূত্র : মিডল ইস্ট আই

গাজা গণহত্যা বন্ধে উত্তাল যুক্তরাষ্ট্র, তিন শতাধিক সংগঠনের সম্মিলিত বিক্ষোভ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top