শায়খ আবু তাসনিম
শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর মধ্য দিয়ে শিশুরা শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা, সহযোগিতা ও পরমত সহিষ্ণুতা শেখে। সেজন্য শিশুকে গদবাঁধা অভ্যাসে অভ্যস্ত না করে খেলার সুযোগ দিতে হবে। ওই পরিবেশও অভিভাবককে তৈরি করে দিতে হবে। নিজেও তাদেরকে সঙ্গ ও সময় দিতে হবে। এতে শিশুর বিকাশ সুন্দর ও সুষ্ঠু হবে। শিশু শরীরের যথাযথ গঠন হয়। পাশাপাশি শিশুর কর্মস্পৃহাও বৃদ্ধি পায়।
এজন্য দেখা গেছে, আল্লাহর রাসূল সা. কখনো নিজেই শিশুদের সাথে আনন্দে অংশ নিয়েছেন। কখনো খেলতে দেখে কিছু বলেননি। বরং উৎসাহিত করেছে। জাবের রা. বলেন, একবার আমরা এক ব্যক্তির দাওয়াতে তার বাড়ি যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে দেখা গেলো, হজরত হুসাইন রা. খেলা করছেন। রাসূল সা. তাকে দেখে একটু এগিয়ে গেলেন। এরপর তার হাত দুটি হুসাইন রা. এর দিকে প্রশারিত করলেন। তখন হুসাইন রা. লুকোচুরি শুরু করলেন। তখন নবীজি সা. তাকে হাসতে হাসতে ধরে ফেলেন। এরপর তিনি তাঁর এক হাত হুসাইন রা. এর চোয়ালের নিচে রাখলেন। অপর হাত তার মাথার তালুতে রাখলেন। এরপর চুমু খেলেন।
ইবনে আব্বাস রা. বলেন, একবার আমি পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলা করছিলাম। তখন সেদিক দিয়ে রাসূল সা. কোথাও যাচ্ছিলেন। নবীজি সা.কে দেখে আমি একটু লুকানোর চেষ্টা করলাম। তখন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, মুআবিয়াকে ডেকে নিয়ে এসো। আমি ফিরে এসে জানালাম, তিনি খাবার খাচ্ছেন।
রাসূল সা. নিজেও ছোটবেলা খেলাধুলা করতেন। হজরত জিবরীল আমিন খেলার সময়ই এসে নবীজি সা. এর সাক্কে সদর বা বক্ষ বিদীর্ণ করেন। এ বিষয়ে প্রসিদ্ধ হাদিসও রয়েছে। সেজন্য শিশুদের খেলাধুলায় বাধা দেয়া যাবে না। বরং এর জন্য পরিবেশও তৈরি করে দিতে হবে।
শিশুদের সবসময় পড়ার টেবিলে বসিয়ে রাখা ঠিক নয়। যখন পড়ার সময় তখন পড়বে। এর বাইরে চিত্ত বিনোদনেরও সুযোগ দিতে হবে। সেজন্য মাঝে মধ্যে বাইরে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাওয়া। আত্মীয়-স্বজনের সাথে সাক্ষাৎ করানো। ইত্যকার কাজগুলো করা যেতে পারে। এতে এক দিকে পড়াশোনার চাপ কমবে। আরেকদিকে মন ফুরফুরে থাকায় সবকিছুতে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করবে। এ বিষয়ে ইমাম গাজালী রহ. বলেন, শিশু যখন মক্তব থেকে ফিরে আসে, তখন তাকে খেলাধুলার সুযোগ দেয়া উচিত। যাতে দীর্ঘ সময়ের পড়াশোনার চাপ দূর হয়ে যায়। শিশুকে যদি খেলাধুলার সুযোগ না দেয়া হয় এবং সারাক্ষণ বই-খাতা নিয়ে বসে থাকতে বাধ্য করা হয়, তাহলে তার স্বতঃস্ফূর্ততা বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে। পড়াশোনা তার কাছে কারাগারের শাস্তি বলে মনে হবে। ফলে সে যেকোনোভাবে এই বন্দিদশা থেকে মুক্তির জন্য অস্থির হয়ে উঠবে। (ইহয়াউ উলুমিদ দীন : ৩ : ৫৯)
শিশুদেরকে খেলার সুযোগ দিতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, তারা যেন এমন কোনো খেলা না খেলে যাতে ব্যথা পাওয়ার অথবা অতি পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। কারণ, খেলার উদ্দেশ্য হলো শরীর চালনার মাধ্যমে শিশু শরীরের গড়ন যথাযথ করা, অলতা দূর করা এবং বুদ্ধিকে শানিত করা। এর জন্য ওই ধরনের খেলার দরকার নেই।
ইবনে মিসকাওয়াইহ বলেন, ‘কিছু সময় শিশুকে খেলাধুলার সুযোগ দেয়া চাই। যাতে পড়াশোনার ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, এমন কোনো খেলায় যেন না খেলে, যাতে ব্যথা পাওয়ার বা অতি পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। বলা বাহুল্য, শরীর চালনা স্বাস্থ্যকে রক্ষা করে, অলসতা দূর করে, বুদ্ধিকে শাণিত করে, নতুন উদ্যম সৃষ্টি করে এবং মনে প্রশান্তি দেয়।’ (তাহজিবুল আখলাক, পৃষ্ঠা ২০)
তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যেন এই সুযোগে খারাপ ছেলেদের সাথে যেন না মেশে। আল্লাহর রাসূল সা. বলেন, শোনো, তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। সুতরাং প্রত্যেককে তার দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে। .. সুতরাং পরিবার কর্তা পরিবারের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। তাদের ব্যাপারে তিনি জিজ্ঞাসিত হবেন। (বুখারী-মুসলিম) এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে ঈমানদারেরা, তোমরা নিজে জাহান্নাম থেকে বাঁচো। তোমাদের পরিবারকেও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। (সূরা তাহরিম, আয়াত : ৬)
আর খেলা নির্বাচনের সময় বিশেষভাবে দুটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। যেন তাতে ভালোভাবে শরীর চালনা হয় এবং সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে বুদ্ধি শাণিত হয়। এই দুটি বিষয়ের সমন্বয় করে খেলা নির্বাচন করা সব দিক থেকেই উপকারী। যেমন একটি ধরণ এমন হতে পারে যে সংখ্যার খেলা খেলা হবে। পরিবারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়ে ১০টি স্লেট নেয়া হবে। সেখানে এক দুই তিন করে দশ পর্যন্ত লেখা থাকবে। এবার প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় ওই স্লেট নিয়ে বাবা ছেলে খেলবে। প্রথমে বাবা সংখ্যা বলবে, ছেলে দৌঁড়ে গিয়ে সেখানে দাঁড়াবে। এভাবে বাবা নানা সংখ্যা একের পর এক বলবে। আর ছেলে সেখানে গিয়ে দাঁড়াবে। স্লেটগুলোর মাঝে পর্যাপ্ত ব্যবধান রাখবে। যেন তার শরীর চালনাও হয়। আবার সংখ্যাগুলোও সুন্দরভাবে চেনে। এভাবে সৃজনশীল নানা খেলাধুলায় বাচ্চাদের অভ্যস্ত করা যেতে পারে।
নানা গবেষণায় দেখা গেছে, খেলাধুলা শুধুমাত্র শিশুর শারীরিক বিকাশেই নয়। বরং মানসিক, সামাজিক এবং আবেগিক বিকাশেও অপরিসীম ভূমিকা পালন করে। তাই পিতামাতাদের উচিত তাদের সন্তানদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা এবং এর জন্য যথাযথ সুযোগ তৈরি করা এবং সমর্থন প্রদান করা।
মনে রাখতে হবে যে এভাবে খেলাধুলায় উৎসাহিত করা, এর জন্য যথাযথ সুযোগ তৈরি করা এবং নিজেও সঙ্গ দেয়া হলো সন্তানের প্রাপ্য অধিকার। আল্লাহর রাসূল সা. নিজের শত ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও বিকেলে ছেলে ইবরাহিমকে দেখতে মদিনার শেষ মাথা পর্যন্ত যেতেন। অনেক ব্যস্ততার মাঝেও ফাতেমা রা. এর বাড়িতে গিয়ে নাতিদেরকে সময় দিতেন। সেজন্য আমাদেরকেও এভাবে সন্তানকে সময় দিতে হবে। আল্লাহর রাসূল সা. বলেন, ‘পিতা-মাতার ওপর সন্তানের অধিকার হলো তাকে লেখাপড়া শিক্ষা দেবে, সাঁতার শিক্ষা দেবে এবং তিরন্দাজি ও অসি চালনা শিক্ষা দেবে।’ (মুসলিম ও তিরমিজি)। সুতরাং আমাদের উচিত, শিশুদের যত্ন করা, তাদের সঙ্গ দেয়া। দিনের কিছু সময় খেলাধুলার পরিবেশ দেয়া। আল্লাহ তায়ালা আমাদের আমল করার তাওফিক দান করেন। আমিন।