ইসলামে জুলুমের ধারণা

শায়খ ইবনুল কালাম
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানব জীবনের প্রতিটি দিক নিয়ে রয়েছে এর সমৃদ্ধ নীতিমালা। এই প্রবন্ধে আমরা সমাজবিজ্ঞানের একটি থিওরি নিয়ে আলোচনা করব। তা একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। হাদিসটি হলো এই,
انصر أخاك ظالما أو مظلوما
এই হাদিসে আল্লাহর রাসূল সা. বলেন, তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য করো। চাই সে জালেম হোক কিংবা মাজলুম। সাহাবায়ে কেরাম আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, মাজলুমকে সাহায্য করার প্রয়োজনীয়তা তো আমরা উপলব্ধি করি। কিন্তু জালেমকে কেন সাহায্য করব? তখন আল্লাহর রাসূল সা. কথাটা ব্যাখ্যা করলেন। বললেন, মাজলুমকে সাহায্য করার অর্থ তাকে জুলুম থেকে বাঁচানো। আর জালেমকে সাহায্য করার অর্থ হলো তাকে জুলুম থেকে বিরত রাখা।

এই হাদিসে আল্লাহর রাসূল সা. চারটি শব্দ ব্যবহার করেছেন। এর প্রত্যেকটিই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি শব্দের মাধ্যমে একেকটি বিষয়ের সংস্কার সাধন করা হয়েছে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক।

হাদিসে বর্ণিত প্রথম শব্দটি হলো انصر বা সাহায্য করো। এই শব্দের মাধ্যমে রাসূল সা. সমাজের একটি বিশেষ ধারণার সংস্কার করেছেন। মানুষ মনে করে, কেবল অন্যায় থেকে বাঁচানোই বুঝি সাহায্য। অন্যায় থেকে বিরত রাখা সাহায্য নয়। ওই চিন্তার পরিবর্তন এনে রাসূল সা. বলেন, না। মাজলুমকে কেবল অন্যায় থেকে বাঁচানোই সাহায্য নয়। বরং জালেমকে তার অন্যায় থেকে নিবৃত্ত করাও সাহায্যের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্য দিয়ে আল্লাহর রাসূল যেভাবে চিন্তার সংস্কার করেছেন। একইভাবে জালেমের স্বজন ও সুজনকেও একটি দায়িত্ব দিয়েছেন। সেটি হলো, নিজের বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনকে অন্যায়ে দেখলে তাকে অন্যায় থেকে বিরত রাখাও তাদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। সেজন্য আত্মীয়-স্বজনের কাউকে অন্যায়ে লিপ্ত দেখলে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা একজন সত্যিকারের মুসলিমের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
আল্লাহর রাসূল সা. দ্বিতীয় যে শব্দ ব্যবহার করেছেন তা হলো أخاك অর্থাৎ ভ্রাতৃত্ব। জালেমের জুলুম দেখে তেলে-বেগুনে রেগে যাওয়া যাবে না। বরং ভ্রাতৃপ্রতীম মনোভাবে অগ্রসর হতে হবে। এক ভাই যেমন অপর ভাইয়ের ভুল দেখলে উপযুক্ত পন্থায় তাকে সংশোধনের উপায় বাতলে দেয়, ঠিক তদ্রুপভাবে জালেমকে জুলুমে দেখলে তাকে উপযুক্ত পন্থায় শুধরাতে হবে। কাউকে হয়তো সুন্দর কথার মাধ্যমে বললে সে শুধরে নেবে, তবে তাকে সুন্দর কথার মাধ্যমে জুলুম থেকে ফেরানোর চেষ্টা করতে হবে। কাউকে শুধরানোর জন্য হয়তো মৃদু তিরস্কার করতে হয়। আবার কাউকে শুধরানোর জন্য বলও প্রয়োগ করতে হয়। মোটকথা একজন ভাই অপর ভাইকে ক্ষতিকর বিষয় থেকে বাঁচানোর জন্য যেসব উপায় অবলম্বন করে। একই ধরণের উপায় অবলম্বন করে জালেমকে তার জুলুম থেকে ফেরাতে হবে।

এখানে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। রাসূল সা. এখানে বলেছেন, তোমার ভাই। অর্থাৎ জালেমকে সংশোধনের দায়িত্ব আলাদাভাবে প্রত্যেকের উপর থাকবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো কাজের দায়িত্ব সম্মিলিত সবার উপর দিলে যথাযথভাবে আদায় হয় না। সেক্ষেত্রে আলাদাভাবে সবাইকে দায়িত্ব দেয়া ভালো। জালেমকে জুলুম থেকে নিবৃত্ত করা একটি গুরু দায়িত্ব। এর জন্য সাহস ও প্রজ্ঞা প্রয়োজন হয়। আবার জালেমের রোষানলেও পড়তে হতে পারে। সেজন্য সবাই হিম্মত নাও করতে পারে। তো সম্মিলিতভাবে সবার উপর দায়িত্ব দিলে সবাই অন্যজনের অপেক্ষায় থাকার আশঙ্কা রয়েছে। সেজন্য প্রত্যেককে আলাদা আলাদাভাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যেন সবাই নিজ স্থান থেকে মেহনত করে। এতে দেখা যাবে অভাবনীয় ফল আসবে।

রাসূল সা. এর তৃতীয় শব্দটি ছিল ظالما তথা জুলুমকারী। জালেম আসলে কে? আমরা মনে করি, যে অন্যের হক নষ্ট করে, সে-ই আসলে জালিম। কিন্তু ইসলামে জুলুমের আরো ব্যাপক। শরীয়তের দৃষ্টিতে জুলুমের ধারণা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি রহ. বলেন,
الظلم وضع الشيء في غير محله
অর্থাৎ কোনো কিছুকে আপন স্থানে না রেখে অন্যত্র রাখাই জুলুম। এটা হতে পারে নিজের ব্যক্তি জীবনের সাথে সম্পৃক্ত কোনো বিষয়। হতে পারে পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রের সাথে সম্পৃক্ত কোনো বিষয়। যেমন বান্দা হিসেবে আমার কর্তব্য হলো বিনয়ী হওয়া। কিন্তু সেখানে আমি যদি বিনয়ী না হয়ে অহঙ্কার প্রদর্শন করি, তবে এটাও এক প্রকারের জুলুম। আমার দায়িত্ব ছিল, স্ত্রীকে তার প্রাপ্য যথাযথভাবে আদায় করা, পিতা-মাতার খেদমত করা, সন্তান-সন্ততিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা। আমি যদি এই দায়িত্বগুলো পালন না করি, স্ত্রীর সাথে প্রেমময় আচরণ করলাম না, মাতা-পিতার বাধ্যগত হলাম না। সন্তানকে বিপথে চলার অনুমতি দিয়ে রাখলাম, তবে এটাও একটা জুলুম। এমনিভাবে আমি যদি দায়িত্বশীল হই, তবে আমাকে আমার প্রজাদের যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নেয়া, আমার দায়িত্ব। আমি যদি তাদের যৌক্তিক চাহিদা মেনে না নেই। তবে এটাও একটি জুলুম। এভাবে মানব জীবনের যে পাঁচটি অধ্যায় রয়েছে তথা আকায়েদ, ইবাদাত, মুআমালা, মুআশারা ও আখলাক, এই অধ্যায়গুলোর মধ্যে ইসলাম আমাদেরকে যে দিক-নির্দেশনা দিয়েছে, এগুলো যদি আমরা যথাযথভাবে আদায় না করি, তবে আমরা জুলুমে লিপ্ত। আমাকে সেই জুলুম থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এমনিভাবে আমার উপর কর্তৃত্ব রাখেন কিংবা আমাকে ভালোবাসেন, এমন কেউ যদি আমাকে কোনো প্রকারের জুলুমে লিপ্ত দেখেন, তবে তার দায়িত্ব হয়ে পড়বে আমাকে এই জুলুম থেকে ফেরানো। তিনি যদি এই দায়িত্ব পালন না করেন, তবে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে।

আজকাল অনেককেই দেখা যায়। আমার পছন্দের নেতা কোনো জুলুমে লিপ্ত। আমি হয়তো বিষয়টি অপছন্দ করি। কিন্তু নেতা যেহেতু করেছেন, তাই ওই বিষয়ে প্রতিবাদ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করি না। এটি ভুল চিন্তা। এই চিন্তারও সংস্কার দরকার। সেজন্য রাসুল সা. বলেছেন, তোমার জালেম ভাইকেও সাহায্য করো। এই চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বরং প্রিয় নেতাও যদি জুলুমে লিপ্ত থাকে, তাকে ওই জুলুম থেকে বের করে আনার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। নয়তো মনে রাখতে হবে, জুলুমের কালে চুপ থাকাও জুলুমের পক্ষ নেয়ার নামান্তর। এক হাদিসে এসেছে,
الساكت عن الحق شيطان أخرس
তথা সত্য প্রকাশে নির্লিপ্ত ব্যক্তি মিটমিটে শয়তান বা বোবা শয়তান। সেজন্য নেতা বা প্রধানরাও যদি কোনো জুলুমে লিপ্ত থাকেন, তাহলে তার বিহিত করতে হবে। এই বিষয়টিই অন্য হাদিসে ভিন্নভাবে এসেছে। হাদিসটি আগে দেখা যাক। তা হলো,
الدين النصيحة، قيل : لمن؟ قال : لله ولكتابه ولرسوله واليوم الآخر ولأيمة المسلمين ولعامتهم.
তো এখানে মুসলিমদের প্রধানের হিতকামনার ব্যাখ্যায় হাদিস বিশারদগণ এমন ব্যাখ্যাই দিয়ে থাকেন। মুসলিমদের প্রধান তিনি যদি হকের উপর থাকেন, তবে তাকে মান্য করা। আর যদি বিপথে থাকেন, তাহলে তাকে সুপথে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা করা। এটাই হলো তাদের জন্য হিতকামনা। এই হলো আমাদের আলোচ্য বিষয়ে বর্ণিত জালেম ভাইকে সাহায্য করা।

রাসূল সা. এর চতুর্থ শব্দ ছিল أو مظلوما তথা নির্যাতিত। মাজলুমকে জুলুম থেকে বাঁচানোর অর্থ জালেমের অবিচার থেকে কেবল তাকে মুক্ত করাই নয়। বরং মাজলুমের সাথে একাত্মতা পোষণ করাও মাজলুমকে সহযোগিতা করার অন্তর্ভুক্ত। অনেকে মাজলুমের অবস্থাকে তার ব্যক্তিগত বিষয় মনে করে। কিন্তু জুলুম গোটা মানবতার জন্য হুমকি। তাই এর নির্মূলের দায়িত্ব পুরো মানব সমাজের। কারণ, জুলুমের মুখে প্রতিরোধ গড়ে না ওঠা জালেমকে বেপরোয়া করে দেয়। তখন সে জুলুমের পরিধি বৃদ্ধি করতে থাকে। সেজন্য অঙ্কুরেই জুলুমকে নির্মূল করে দিতে হবে।

এই হাদিসের মাধ্যমে আল্লাহর রাসূল সা. একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাজ বিজ্ঞান থিওরি তুলে ধরেছেন। মূল কথা হলো, মাজলুমকে স্বৈরাচার থেকে মুক্ত করা এবং জালেমকে তার জুলুম থেকে বিরত রাখা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। কেউ যদি তার এই কর্তব্যে অবহেলা করে, তবে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আজাবের হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
ولا تركنوا إلى الذين ظلموا فتمسكم النار
অর্থাৎ তোমরা জালেমদের প্রতি ঝুঁকে পড়ো না। তা না হলে তোমাদেরকে আগুন স্পর্শ করবে। (সূরা হুদ, আয়াত ১১৩)
এছাড়া একজন মুমিনের জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া – আল্লাহ তায়ালার মোহাব্বাত – থেকে সে বঞ্চিত হবে। কারণ, আল্লাহ তায়ালা জালেমকে পছন্দ করেন না। ঘোষিত হয়েছে,
إن الله لا يحب الظالمين তথা আল্লাহ জালেমদের ভালোবাসেন না।
পৃথিবীতে যদি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ করতে হয়, তবে ইসলামী সমাজবিজ্ঞানের এসব থিওরির বিকল্প নেই। সেজন্য মানুষ যত দ্রুত ইসলামের ছায়াতলে আসবে, সুখের সুবাতাস ততই ত্বরান্বিত হবে।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে জালেমকে তার জুলুম থেকে বিরত রাখার এবং মাজলুমকে সহযোগিতা করার তাওফিক দান করেন। একটি সুন্দর সমাজ নতুন প্রজন্মকে উপহার দেয়ার তাওফিক দান করেন। ব্যক্তি জীবন থেকে পররাষ্ট্রজীবন পর্যন্ত ইসলাম পরিপালনের তাওফিক দিন। আমিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top