মূর্তি, ভাস্কর্য, ডিজিটাল ছবি

ইসলামে মূর্তি, ভাস্কর্য ও ডিজিটাল ছবি : কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিধান

শায়খ ইবনুল কালাম

আল্লাহ তায়ালা যেসব কাজকে সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করেন, তার মধ্যে অন্যতম একটি কাজ হলো, সৃষ্টিতে তার সাদৃশ্যতা অবলম্বনের চেষ্টা করা। এজন্য যারা সৃষ্টিতে আল্লাহ তায়ালার সাদৃশ্য অবলম্বনের চেষ্টা করে, তাদের শাস্তির মাত্রা একটু বেশিই হয় এবং এটি অন্যতম নিকৃষ্ট কবির গুনাহ। এখান থেকেই মূর্তি, ভাস্কর্য বা এই জাতীয় যেকোনো কার্য সম্পাদনা করা শরীয়তে পরিত্যাজ্য। এ ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে।

ইসলামে মতভেদ : গ্রহণযোগ্যতা ও সীমারেখা

আমরা আজকের প্রবন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব। সেজন্য আগে কুরআন সুন্নাহে বর্ণিত এ সংক্রান্ত আয়াত ও হাদিসগুলো আমরা জানব। যেন বিষয়টির বিশ্লেষণে যাওয়া এবং বাস্তবতা বুঝা আমাদের জন্য সহজ হবে।

ইসলামে মূর্তি, ভাস্কর্য ও ডিজিটাল ছবির বিধান

মূর্তি বা ভাস্কর্য সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْاَوْثَانِ وَ اجْتَنِبُوْا قَوْلَ الزُّوْرِ

অর্থাৎ ‘তোমরা অপবিত্র বস্তু তথা মূর্তিসমূহকে পরিহার করো এবং মিথ্যাকথন থেকে বেঁচে থাকো।’ সূরা হজ্ব, আয়াত : ৩০ এখানে মূর্তির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞার শব্দ হলো الأوثان এটি মনে রাখতে হবে।

মূর্তিপূজার প্রসঙ্গে বর্ণিত আরো কিছু আয়াতে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন,

اِنَّمَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ اَوْثَانًا وَّ تَخْلُقُوْنَ اِفْكًا

অর্থাৎ তোমরা তো আল্লাহর পরিবর্তে মূর্তির পূজা করো আরা তোমরা মির্থা নির্মাণ করো। সূরা আনকাবুত, আয়াত : ১৭

অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَ قَالَ اِنَّمَا اتَّخَذْتُمْ مِّنْ دُوْنِ اللهِ اَوْثَانًا، مَّوَدَّةَ بَیْنِكُمْ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا،  ثُمَّ یَوْمَ الْقِیٰمَةِیَكْفُرُ بَعْضُكُمْ بِبَعْضٍ وَّ یَلْعَنُ بَعْضُكُمْ بَعْضًا ؗ وَّ مَاْوٰىكُمُ النَّارُ وَ مَا لَكُمْ مِّنْ نّٰصِرِیْنَ.

অর্থাৎ তিনি (ইবরাহিম আ.) বললেন, তোমরা তো পার্থিব জীবনে পারস্পরিক বন্ধুত্ব বজায় রাখার জন্য আল্লাহর পরিবর্তে মূতিসমূহকে গ্রহণ করেছো। কিন্তু কিয়মতের দিন তোমরা একে অপরকে অস্বীকার করবে এবং অভিসম্পাত দেবে। তোমাদের আবাস হবে জাহান্নাম এবং তোমাদের কোনো সাহায্যকারী থাকবে না। সূরা আনকাবুত, আয়াত : ২৫

আমলে কাসিরের পরিচয়, কেন আমলে কাসিরে নামাজ ভাঙ্গে

ভাস্কর্য নিয়ে কুরআনে বর্ণিত আরেকটি শব্দ হলো তিমসাল। আল্লাহ তায়ালা এ বিষয়ে বলেন,

اِذْ قَالَ لِاَبِیْهِ وَ قَوْمِهٖ مَا هٰذِهِ التَّمَاثِیْلُ الَّتِیْۤ اَنْتُمْ لَهَا عٰكِفُوْنَ،  قَالُوْا وَجَدْنَاۤ اٰبَآءَنَا لَهَا عٰبِدِیْنَ.

অর্থাৎ সেই সময়কে স্মরণ করো, যখন সে (ইবরাহিম আ.) নিজ পিতা ও নিজ সম্প্রদায়কে বলেছিলেন যে এই ভাস্কর্যগুলো কী, যার সামনে তোমরা ধরনা দিয়ে থাকো? তারা বলল, আমাদের বাপ-দাদাদেরকে এদের পূজা করতে দেখেছি। সূরা আম্বিয়া, আয়াত : ৫৩-৫৩

হাদিসেও এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। বিশিষ্ট তাবেয়ী আবুল হাইয়াজ আসাদী রহ.কে হযরত আলী রা. বলেন,

أَلَا أَبْعَثُكَ عَلَى مَا بَعَثَنِي عَلَيْهِ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ أَنْ لَا تَدَعَ تِمْثَالًا إِلاَّ طَمَسْتَهُ وَلَا قَبْرًا مُشْرِفًا إِلاَّ سَوَّيْتَهُ. وفي رواية: وَلَا صُورَةً إِلاَّ طَمَسْتَهَا.

অর্থাৎ ‘আমি তোমাকে ওই কাজের দায়িত্ব দিয়ে পাঠাবো না, যে কাজের জন্য নবীজি সা. আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? তা এই যে তুমি সকল প্রাণীর প্রতিকৃতি বিলুপ্ত করবে এবং সকল সমাধি-সৌধ ভূমিস্মাৎ কর দেবে।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে, এবং সকল চিত্র মুছে ফেলবে। সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৯৬৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৩২১৮; সুনানে নাসাঈ, হাদিস : ২০৩১

মব জাস্টিস প্রতিরোধে ইসলামের কর্ম-কৌশল

হাদিসে বর্ণিত তৃতীয় আরেকটি শব্দ আছে। তা হলো তাসবির (التصوير)। এ বিষয়ে আল্লাহর রাসূল সা. বলেন,

إِنَّ الَّذِينَ يَصْنَعُونَ هَذِهِ الصُّوَرَ يُعَذّبُونَ يَوْمَ القِيَامَةِ، يُقَالُ لَهُمْ: أَحْيُوا مَا خَلَقْتُم.

অর্থাৎ যারা এসব প্রতিকৃতি তৈরি করে, তাদেরকে কিয়ামতের দিন আযাবে নিক্ষেপ করা হবে। তাদেরকে বলা হবে, যা তোমরা সৃষ্টি করেছিলে, তাতে প্রাণ সঞ্চার করো। সহিহ বুখারী, হাদিস : ৫৯৫১; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২১০৭

অন্য হাদিসে এসেছে। হজরত আয়েশা রা. বলেন,

دَخَلَ عَلَيَّ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَنَا مُتَسَتِّرَةٌ بِقِرَامٍ فِيهِ صُورَةٌ، فَتَلَوَّنَ وَجْهُهُ، ثُمَّ تَنَاوَلَ السِّتْرَ فَهَتَكَهُ، ثُمَّ قَالَ: إِنَّ مِنْ أَشَدِّ النَّاسِ عَذَابًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ، الَّذِينَ يُشَبِّهُونَ بِخَلْقِ اللهِ.

তথা রাসূল সা. আমার নিকল এলেন। আমি একটা পর্দা ঝুলিয়েছিলাম, যাতে ছবি অঙ্কিত ছিল। তা দেখে নবীজি সা. এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি পর্দাটা খুলে ছিঁড়ে ফেললেন এবং বললেন যে কিয়ামতের দিন তাদেরকে কঠিন আযাব দেয়া হবে, যারা আল্লাহর সৃষ্টি-বৈশিষ্ট্যের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করে। সহিহ বুখারী, হাদিস : ৫৯৫৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২১০৭

অর্থবাজারে ইসলামের নির্দেশনা

কুরআন ও সুন্নাহে বর্ণিত মৌলিক এই তিনটি শব্দ আমাদের আলোচনার স্বার্থে অভিধান শাস্ত্রবিদদের থেকে তাহকিক করে নেই। তাহলে মূল আলোচনা বুঝা আমাদের জন্য আরেকটু সুবিধা হবে।

আমাদের চিহ্নিত প্রথম শব্দটি হলো الأوثان এই শব্দটি বহুবচন। এর একবচন হলো وثن এই শব্দটির অর্থ লিখতে গিয়ে বিশিষ্ট অভিধানশাস্ত্রবিদ ইমাম ইবনুল আছির রহ. বলেন, এর দুটি অর্থ আছে। এক. সর্বদা স্থির দাঁড়িয়ে থাকে, এমন বস্তু। দুই. যেকোনো ধরনের মূর্তি।

এবার কুরআনের আয়াতটি আমরা আবার দেখি। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْاَوْثَانِ وَ اجْتَنِبُوْا قَوْلَ الزُّوْرِ

তাহলে এর অর্থ দাঁড়াবে যেকোনো ধরনের মূর্তিকেই তোমরা পরিহার করো। সুতরাং এই আয়াত দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে কোনো ধরনের মূর্তিই ইসলামে সমর্থিত নয়। তা পরিহার করতে হবে।

এখন পরিহারের পথ ও পন্থা সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে ফুকাহায়ে কেরাম বলেন, মূর্তি সংগ্রহ, মূর্তি সংরক্ষণ এবং মূর্তির বেচাকেনা ইত্যাদি সকল বিষয় এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।

وثن শব্দটি যেহেতু সব ধরনের মূর্তিকেই শামিল করে, সেজন্য ফুকাহায়ে কেরাম বলেন, মূর্তি যে নামেই হোক, তা নিষিদ্ধ। চাই তা মূর্তি নামে থাকুক অথবা ভাস্কর্য কিংবা অন্য কোনো নামে থাকুক। সকল নামেই মূর্তি নিষিদ্ধ। এমনকি মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণ, সংগ্রহ, সংরক্ষণ ইত্যাদি সকল বিষয়ের অবৈধতার উপর গোটা মুসলিম উম্মাহর ইজমাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং কোনো নামেই মূর্তিকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। সর্ববস্থায়ই মূর্তি পরিত্যাজ্য।

খেলাপিঋণ : সমস্যা ও উত্তরণের উপায়

কুরআনে বর্ণিত আরেকটি শব্দ হলো التماثيل এটিও বহুবচন শব্দ। এর একবচন হচ্ছে تمثال এই তিমসালের অর্থ লিখতে গিয়ে ইবনে মানযুর রহ. বলেন, এর তিনটি অর্থ রয়েছে। তা হলো, এক. চিত্র বা প্রতিকৃতি। দুই. ছায়া বা প্রতিচ্ছবি। তিন. আল্লাহ তায়ালার কোনো মাখলুকের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বস্তু বানানো।

এবার আমরা হাদিসে ফিরে আসি। আলী রা. বলেন,

أَلَا أَبْعَثُكَ عَلَى مَا بَعَثَنِي عَلَيْهِ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ أَنْ لَا تَدَعَ تِمْثَالًا إِلاَّ طَمَسْتَهُ وَلَا قَبْرًا مُشْرِفًا إِلاَّ سَوَّيْتَهُ. وفي رواية: وَلَا صُورَةً إِلاَّ طَمَسْتَهَا.

অর্থাৎ যত ধরনের চিত্র, প্রতিকৃতি, ছায়া, প্রতিচ্ছবি কিংবা আল্লাহ তায়ালার মাখলুকের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বস্তু আছে, সবকিছুকে বিলুপ্ত করতে হবে এবং মুছে ফেলতে হবে।

সুতরাং যেকোনো ধরনের প্রাণীর চিত্র, প্রতিকৃতি, ছায়া, প্রতিচ্ছবি কিংবা আল্লাহ তায়ালার মাখলুকের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বস্তু পরিহার করতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো ধরনের কোনো ছাড় শরীয়তে নেই।

তৃতীয় শব্দ হলো তাসবির। এ বিষয়ে বিখ্যাত অভিধান শাস্ত্রবিদ ইমাম রাগেব আসফাহানী রহ. বলেন,

الصورة ما ينتقش به الأعيان ويتميز بها غيرها وذلك ضربان: أحدهما محسوس يدركه الخاصة والعامة، بل يدركه الإنسان وكثير من الحيوان كصورة الإنسان والفرس والحمار بالمعاينة، والثاني: معقول يدركه الخاصة دون العامة، كالصورة التي اختص الإنسان بها من العقل، والروية، والمعاني التي خص بها شيء بشيء،

অর্থাৎ ছবি হলো এমন বস্তু, যাতে কোনো জিনিস আঁকা হয় এবং এর দ্বারা তা অন্য যেকোনো জিনিস থেকে পার্থক্য হয়ে যায়। এটি দুই প্রকার। এক. এমন দৃশ্য যা পঞ্চইন্দ্রিয় দ্বারা স্পর্শ করা যায়। যাকে সাধারণ থেকে নিয়ে প্রাণীরা পর্যন্ত দেখতে ও চিনতে পারে। যেমন মানুষ, ঘোড়া ও গাধার ছবি। দুই. এমন দৃশ্য যেটা বিশেষ শ্রেণি অনুধাবন করতে পারে। সবাই অনুধাবন করতে পারে না। যেমন, মানুষ তার বিশেষ বুদ্ধি, অন্তর্দৃষ্টি ও তার সাথে বিশেষিত বিষয়াবলীর মাধ্যমে বুঝতে পারে এমন ছবি।

এর দ্বারা বুঝা যায় তাসবির বা ছবির সংজ্ঞা অনেক ব্যাপক। এটি যেমন হাতে অঙ্কিত ছবিকে শামিল করে। একইভাবে ফিল্ম ক্যামেরা বা ইলেক্ট্রনিক রশ্মির আকারে স্ক্রিণে দৃশ্যের আকারে প্রকাশিত সব ছবিকেই শামিল করবে। সেজন্য আভিধানিক সংজ্ঞা ও নুসুসের ব্যাপকতায় সবধরনের ছবিই নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত হবে।

লেখক : পরিচালক, নদওয়াতুল হানাফিয়া বাংলাদেশ

করারোপে ইসলামের নির্দেশনা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top