উইঘুর নিপীড়ন

উইঘুর নিপীড়ন : আর্থিক দমন-পীড়নের মাধ্যমে উইঘুরদের নিশ্চিহ্ন করছে চীন

আর্থিক দমন-পীড়নের মাধ্যমে উইঘুর জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে চাইছে চীন। সেজন্য উইঘুর জোরপূর্বক শ্রম, শারীরিক নির্যাতন, গুম, ক্যাম্পে আটকে রাখাসহ বহুমাত্রিক নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে দেশটি।

হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, উত্তর-পশ্চিম চীনে অবস্থিত স্বায়ত্তশাসিত উইঘুর অঞ্চলের মুসলিম জাতিগত গোষ্ঠী উইঘুরদের ওপর চীনের নিপীড়ন বহুমাত্রিক। মানবাধিকার কর্মী রুশান আব্বাস বছরের পর বছর ধরে উইঘুরদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) একদিকে শারীরিক নির্যাতন, গুম, ক্যাম্পে আটকে রাখা, জোরপূর্বক শ্রম ও সাংস্কৃতিক নিধনের পথ বেছে নিয়েছে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক দমন-পীড়নের মাধ্যমে উইঘুরদের অস্তিত্ব বিলীন করার পরিকল্পনা নিয়েছে।

উইঘুর কারা এবং কেন চীনের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে?

একটি সম্পদসমৃদ্ধ অঞ্চল, একটি পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত

বিশ্বের এক-পঞ্চমাংশ তুলার উৎপাদনকারী এই অঞ্চলটি তেল, গ্যাস ও অন্যান্য খনিজ সম্পদে ভরপুর। এটি মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের দিকে চীনের প্রবেশদ্বার হিসেবেও কাজ করে। তথাকথিত ‘স্বায়ত্তশাসন’ থাকা সত্ত্বেও অঞ্চলটি কার্যত সিসিপির কড়া নিয়ন্ত্রণে। এখানে প্রতিটি আর্থিক লেনদেন নজরদারির আওতায়, প্রতিটি ফোনে বাধ্যতামূলকভাবে স্পাইওয়্যার অ্যাপ ইনস্টল করা, ব্যাংকিং তথ্য পর্যন্ত সরাসরি সরকারের হাতে।

আব্বাস বলেন, “উইঘুর অঞ্চলে প্রতিটি স্থান নজরদারির আওতায়। সরকার প্রতিটি উইঘুরের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, লেনদেন, এমনকি ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্পর্কে সব জানে। ব্যাংককে বলা হলে তারা নির্দ্বিধায় উইঘুরদের অ্যাকাউন্টের তথ্য সিসিপিকে সরবরাহ করে।”

আর্থিক দমন : সেন্সরশিপ ও সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ

সিসিপি শুধু তথ্য সংগ্রহেই থেমে নেই। তারা সরাসরি উইঘুরদের আর্থিকভাবে নিঃস্ব করে দিচ্ছে। রাষ্ট্রীয় নির্দেশে উইঘুরদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ, সমাজের নেতাদের গ্রেপ্তার করে তাদের জমি ও ঘর কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে, কীভাবে কৃষিজমির নিয়ন্ত্রণও উইঘুরদের কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হয়েছে — ২০০১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ভূমি-ব্যবহারে স্থানান্তর বেড়েছে ৫০ গুণ।

উইঘুর নিপীড়ন

চীনা সরকার বাড়ির মালিকদের বাধ্য করছে পুনরায় নিবন্ধনের নামে একটি আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে। অথচ বহু মালিক তখন বন্দি শিবিরে আটক। ফলে তাদের জমি ও ঘর হান চীনা বসতি স্থাপনকারীদের দখলে চলে যাচ্ছে।

“যারা তাদের সম্পত্তি পুনরায় দাবি করতে পারেনি, সরকার তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে। বহু ভিডিও রয়েছে, যেখানে হান চীনা বসতি স্থাপনকারীরা উইঘুরদের ঘরে বসবাস করছে,” বলেন আব্বাস।

দারিদ্র্য বিমোচনের নামে জোরপূর্বক শ্রম

‘দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি’ মূলত জোরপূর্বক শ্রমের অন্য নাম। ড. অ্যাড্রিয়ান জেনজের গবেষণায় দেখা গেছে, এটি উইঘুরদের ঐতিহ্যবাহী জীবিকা থেকে সরিয়ে তাদের কারখানাভিত্তিক শ্রমে ঠেলে দেয়, যার মুনাফাভোগী হান চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো। যারা এই স্থানান্তর প্রত্যাখ্যান করে, তাদের শাস্তি পেতে হয়।

আব্বাস বলেন, “তোমার যদি কোনো বিকল্প না থাকে, কারখানায় কাজ করতে বাধ্য হও, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকো — তাহলে এটাকে আর কিছু নয়, আধুনিক দাসত্ব বলা চলে।”

নজরদারি ও দমনের মাধ্যমে নিঃস্বকরণ

এই আর্থিক দমন, সম্পদ জব্দ ও নজরদারির মাধ্যমে উইঘুরদের শুধু দমন নয় — কার্যত নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে চীন। এই ব্যবস্থার অধীনে প্রতিরোধ অসম্ভব হয়ে উঠেছে। উইঘুর জনগোষ্ঠীকে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে নিঃশেষ করার লক্ষ্যে চীন একটি কাঠামোগত নীতি অনুসরণ করছে।

আব্বাস মনে করিয়ে দেন, যোগাযোগ ও আর্থিক লেনদেনের স্বাধীনতা শুধু সুবিধার বিষয় নয়, এটি ব্যক্তিগত ও সাংস্কৃতিক টিকে থাকার প্রশ্ন।

সূত্র : হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top