উইঘুর নির্বাসন

চীনের চাপে উইঘুর নির্বাসন ও বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন থাইল্যান্ডের

চীনের চাপে থাই সরকার উইঘুর নির্বাসন ও বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন এনেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ফেব্রুয়ারির শেষদিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অনুরোধ এবং যুক্তরাষ্ট্রের কড়া বার্তা উপেক্ষা করেই থাইল্যান্ড গোপনে অন্তত ৪০ জন মুসলিম উইঘুর নির্বাসন করে চীনে। এই পদক্ষেপে স্পষ্ট হয়েছে যে থাইল্যান্ডের বৈদেশিক নীতিতে বেইজিংয়ের প্রভাব কতটা গভীরভাবে প্রবেশ করেছে।

উইঘুর নির্বাসন : মানবাধিকারের প্রশ্নবিদ্ধ পদক্ষেপ

নির্বাসিত উইঘুররা গত ১১ বছর ধরে থাইল্যান্ডে আটক অবস্থায় ছিলেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের বন্দিত্বকে অমানবিক আখ্যা দিয়েছে। জানা গেছে, পশ্চিমা বিশ্বের একাধিক দেশ এই শরণার্থীদের রাজনৈতিক আশ্রয় ও নিরাপদ ভবিষ্যতের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। অথচ থাই কর্তৃপক্ষের গোপন সিদ্ধান্তে উইঘুর নির্বাসনের ফলে সব আশার অবসান ঘটে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া : কূটনৈতিক অস্বস্তি

মার্কিন সিনেটর মার্কো রুবিও স্পষ্টভাবে থাইল্যান্ডকে উইঘুরদের চীনে ফেরত না পাঠাতে অনুরোধ করেছিলেন। তথাপি ব্যাংকক উইঘুর নির্বাসন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কূটনৈতিকভাবে অপমান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। থাই প্রধানমন্ত্রী পায়েটোংটার্ন সিনাওয়াত্রা অতীতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুসরণ করে উইঘুর নির্বাসন কর্মসূচি না পালনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যা এ সিদ্ধান্তের পর প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

চীনা অপরাধী সিন্ডিকেট : পেছনের অদৃশ্য চালিকা শক্তি?

কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী ম্যাগনাস ফিসকেজো দ্য ডিপ্লোম্যাটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, থাই কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি চীন-সমর্থিত অপরাধী সিন্ডিকেটগুলোর বিরুদ্ধে কিছু পদক্ষেপ নিলেও এই চক্রগুলো এখনো কম্বোডিয়া, লাওস ও মায়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় সক্রিয়। এসব অপরাধচক্র প্রতারণা কেন্দ্র পরিচালনার পাশাপাশি উইঘুরদের চার্টার্ড ফ্লাইটে জোরপূর্বক চীনে পাঠানোর কাজে যুক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে।

বৈদেশিক নীতিতে মোড়

ফিসকেজো, যিনি পূর্বে বেইজিং ও টোকিওতে সুইডেনের দূতাবাসে কাজ করেছেন এবং বর্তমানে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান ও এশিয়ান স্টাডিজ পড়ান, দীর্ঘদিন ধরে উইঘুরদের দুর্দশা নিয়ে গবেষণা করছেন। তাঁর মতে, এই নির্বাসন শুধুই মানবাধিকারের লঙ্ঘন নয়—বরং এটি থাইল্যান্ডের বৈদেশিক নীতিতে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের গভীর ছাপ।

থাইল্যান্ডের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। একদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ, অন্যদিকে বৈদেশিক কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তনের ইঙ্গিত—এই দুইয়ের মধ্যেই দেশটি একটি স্পর্শকাতর অবস্থানে রয়েছে। উইঘুরদের প্রতি থাইল্যান্ডের অবস্থান শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতির বড় পরিসরে তাৎপর্যপূর্ণ এক নজির হয়ে থাকবে।

চীনে উইঘুর মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর কঠোর দমন-পীড়ন

উইঘুরদের পরিচয়

উইঘুররা মধ্য এশিয়ার তুর্কি জাতিগোষ্ঠীর একটি প্রাচীন শাখা, যাদের সাংস্কৃতিক শিকড়, ভাষাগত পরিচয় এবং ধর্মীয় বিশ্বাস চীন রাষ্ট্রের বর্তমান রাজনৈতিক কাঠামোর সাথে মেলে না। তারা প্রধানত চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলে বসবাস করে। সংখ্যায় প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ থেকে ১ কোটি ৫০ লাখ হবে। ইসলাম ধর্ম, উইঘুর ভাষা ও সংস্কৃতি তাদের পরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দু হলেও চীনা সরকারের চোখে তারা আজ ‘পুনঃশিক্ষার’ লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রিত একটি জাতি।

ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত রেখাচিত্র

উইঘুরদের ইতিহাস ৮ম শতকে প্রতিষ্ঠিত উইঘুর খানাত থেকে শুরু হলেও তারা নবম শতকে বর্তমান জিনজিয়াং অঞ্চলে স্থায়ী হয়। এ সময় তারা বৌদ্ধ, নেস্তোরীয় খ্রিস্টান ও ইসলামি সংস্কৃতির ছোঁয়ায় এক ঐশ্বর্যশালী সভ্যতা গড়ে তোলে।

১০ম শতাব্দীতে কারাখানিদ রাজবংশের মাধ্যমে উইঘুররা ইসলামে দীক্ষিত হয় এবং ইসলাম তাদের জাতীয় পরিচয়ের অংশ হয়ে ওঠে।

মধ্যযুগে সিল্ক রোডের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে উইঘুর অঞ্চল ছিল বাণিজ্য ও জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র।

১৯৩৩ ও ১৯৪৪ সালে উইঘুররা দুটি স্বল্পস্থায়ী স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে – East Turkestan Republic – যা চীনা আগ্রাসনের কাছে টিকে থাকতে পারেনি।

১৯৪৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট বিজয়ের পর উইঘুরদের ঐতিহাসিক মাতৃভূমি পূর্ব তুর্কিস্তানকে জিনজিয়াং (অর্থ: নতুন সীমান্ত) নামে সংযুক্ত করে গণচীন।

উইঘুরদের ভাষা ও সংস্কৃতি

উইঘুর ভাষা একটি তুর্কি ভাষা, যা আরবি লিপিতে লেখা হয় এবং আরবি-ফারসি ও প্রাচীন চাগতাই তুর্কি ভাষার প্রভাব বহন করে। ইসলামী চিন্তাধারা, সঙ্গীত, পোশাক ও জীবনযাত্রায় ধর্ম ও জাতিগত পরিচয়ের গভীর ছাপ রয়েছে।

উইঘুরদের ঐতিহ্যবাহী মুকাম সংগীত, রঙিন পোশাক, কাবাব-নুডলস ঘরানার খাবার এবং লোককথা তাদের সংস্কৃতির অনন্য দিক তুলে ধরে। ইসলাম তাদের জীবনব্যবস্থার অংশ। ঈদ, রমজান, নামাজ, কুরআন চর্চা ইত্যাদি রীতি সামাজিকভাবে গভীরভাবে গাঁথা।

সমসাময়িক সংকট : নির্যাতন ও জাতিগত নিধন?

চীনা সরকারের বিরুদ্ধে উইঘুরদের প্রতি ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু রাষ্ট্র এই পদক্ষেপগুলোকে সাংস্কৃতিক গণহত্যা বা জেনোসাইড হিসেবে অভিহিত করেছে।

চীনের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ

১. পুনঃশিক্ষা শিবির (Re-education Camps):
চীন সরকার লক্ষাধিক উইঘুরকে জোর করে আটক করে ‘শিক্ষা’ ও ‘ডি-র‍্যাডিকালাইজেশন’-এর নামে ধর্মত্যাগ, কমিউনিজম শেখানো এবং মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।

২. ধর্মীয় নিপীড়ন
কুরআন রাখা, নামাজ পড়া, হিজাব পরা, রোজা রাখা – এসব ধর্মীয় অভ্যাসকে ‘চরমপন্থা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মসজিদ ধ্বংস এবং ধর্মীয় নেতাদের আটক ও নিখোঁজ করা সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠেছে।

৩. জোরপূর্বক জন্মনিয়ন্ত্রণ ও পরিবার ভাঙন
উইঘুর নারীদের ওপর গর্ভপাত, বন্ধ্যাকরণ ও সন্তান জন্মে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। অনেক পরিবারকে বিভক্ত করে শিশুকে জোর করে চীনা বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হয়।

৪. সংস্কৃতি ও ভাষার বিলুপ্তি:
উইঘুর ভাষায় শিক্ষা দেওয়া নিষিদ্ধ, ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও নাম নিষিদ্ধ এবং সবকিছুতে মানানসই করে তোলা হচ্ছে হান চীনাদের সংস্কৃতির সঙ্গে।

৫. নজরদারি ও ডিজিটাল দমননীতি
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ফেসিয়াল রিকগনিশন, মোবাইল স্ক্যানার এবং GPS ট্র্যাকারের মাধ্যমে উইঘুরদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

যুক্তরাষ্ট্র উইঘুর ইস্যুতে চীনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং উইঘুর বাধ্যতামূলক শ্রমে উৎপাদিত পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে চীনের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়া

তবে মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়া মিশ্র। তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার সাধারণ জনগণ প্রতিবাদ করলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেক মুসলিম রাষ্ট্র, বিশেষত সৌদি আরব ও পাকিস্তান চীনের প্রতি অনুগত থেকেছে। চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব অনেক রাষ্ট্রের নীরবতার কারণ।

উইঘুর জাতি আজ ইতিহাসের এক সংকটময় অধ্যায় অতিক্রম করছে। একদিকে তারা চীন রাষ্ট্রের দমনমূলক আধুনিক জাতিগঠনের পরীক্ষাগারে বন্দী, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে তাদের মুক্তির কণ্ঠস্বর এখনও দুর্বল। বিশ্ব বিবেক যদি এ নীরবতা না ভাঙে, তবে ২১শ শতকে আরেকটি জাতিগত নিধনের ইতিহাস লেখা হবে প্রযুক্তি-নির্ভর এক নিঃশব্দ নির্মূল অভিযানে।

সূত্র : দ্য ডিপ্লোম্যাট ও অন্যান্য

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top