আব্দুর রহমান ফারুক
পিআর বা Proportional Representation—আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচন ব্যবস্থার ব্যর্থতা বা এর কারণে সৃষ্ট জটিলতাগুলো আরো ভালোভাবে বুঝতে কয়েকটি দেশের নির্দিষ্ট উদাহরণ দেখা যেতে পারে। আমাদের মতো অর্ধশিক্ষিত মানুষের গরিব ও নীতি-নৈতিকতার বালাইহীন দেশে পিআর পদ্ধতি এসব জটিলতার জটিল রূপ নিয়ে আবির্ভূত হবে সেই বিষয়ে যদি সন্দেহ রাখেন তাহলে কিছু বলার থাকে না।
১. ভাইমার জার্মানি (১৯১৯-১৯৩৩)
ভাইমার প্রজাতন্ত্র জার্মানির ইতিহাসে পিআর পদ্ধতির ব্যর্থতার একটি ক্লাসিক উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। ভাইমার সংবিধানে অত্যন্ত বিশুদ্ধ একটি পিআর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল, যেখানে কোনো নির্বাচনী থ্রেশহোল্ড (ন্যূনতম ভোট শতাংশ) ছিল না। এর অর্থ হলো, সামান্য পরিমাণ ভোট পাওয়া দলগুলোও রাইখস্ট্যাগে (সংসদে) আসন পেত।
পরিণতি
অত্যধিক দলীয় খণ্ডীকরণ: এর ফলে জার্মান রাজনীতিতে অসংখ্য ছোট ছোট দলের জন্ম হয়, যারা প্রায়ই একে অপরের থেকে সামান্য ভিন্ন মতাদর্শ ধারণ করতো।
অস্থির জোট সরকার : রাইখস্ট্যাগে কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেত না, যার ফলে প্রায়ই দুর্বল, স্বল্পস্থায়ী এবং মতাদর্শগতভাবে ভিন্ন দলগুলোর জোট সরকার গঠিত হতো। এই সরকারগুলো স্থিতিশীল নীতি প্রণয়নে ব্যর্থ হতো এবং ঘন ঘন ভেঙে যেত।
চরমপন্থী দলের উত্থান: এই ব্যবস্থা নাৎসি পার্টি এবং কমিউনিস্ট পার্টির মতো চরমপন্থী দলগুলোকে সংসদীয় বৈধতা পেতে সাহায্য করে। তারা সংসদে প্রবেশ করে তাদের ধ্বংসাত্মক মতাদর্শ প্রচারের সুযোগ পায়, যা শেষ পর্যন্ত ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের পতনে এবং হিটলারের ক্ষমতা গ্রহণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২. ইসরাইল
ইসরাইলের নির্বাচন ব্যবস্থা একটি অত্যন্ত বিশুদ্ধ পিআর পদ্ধতির উদাহরণ। যেখানে পুরো দেশটিকে একটি একক নির্বাচনী এলাকা (single national constituency) হিসেবে দেখা হয় এবং থ্রেশহোল্ড (আসন পাওয়ার জন্য ন্যূনতম ভোট শতাংশ) অত্যন্ত কম (বর্তমানে ৩.২৫%)।
কেন ব্যর্থ/চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন?
অত্যধিক দলীয় বিভাজন : এই ব্যবস্থা অসংখ্য রাজনৈতিক দলের জন্ম দিয়েছে, যার মধ্যে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ধর্মীয়, আরব-ইসরাইলি এবং অতি-জাতীয়তাবাদী দলও রয়েছে।
ক্রমাগত জোট সরকার: কোনো একক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় ইসরাইলে প্রায়ই জটিল এবং ভঙ্গুর জোট সরকার গঠিত হয়। এই জোটগুলো প্রায়ই কয়েক মাসের মধ্যে ভেঙে যায়, যার ফলে ঘন ঘন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় (যেমন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চার বছরে পাঁচটি নির্বাচন)।
ক্ষুদ্র দলের অত্যধিক প্রভাব : অনেক সময় ক্ষুদ্র দলগুলো সরকারের গঠনে ‘কিংমেকার’ এর ভূমিকা পালন করে। তারা তাদের সংকীর্ণ স্বার্থ বা এজেন্ডা পূরণের জন্য বড় দলগুলোকে বাধ্য করতে পারে, যা স্থিতিশীল ও কার্যকর শাসন ব্যবস্থায় বাধা সৃষ্টি করে।
শাসনে অচলাবস্থা (Governing Paralysis): ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন এবং জোটের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধের কারণে গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ে।
৩. ইতালি (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ৯০-এর দশক পর্যন্ত)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইতালিতে একটি পিআর ব্যবস্থা চালু ছিল, যা ভাইমার জার্মানির মতো অত্যধিক স্থিতিশীলতা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল।
কেন ব্যর্থ?
ইতালির পিআর ব্যবস্থায় নিম্ন থ্রেশহোল্ড এবং একটি অত্যন্ত খণ্ডিত দলীয় ব্যবস্থা ছিল।
পরিণতি
সরকারের ঘন ঘন পতন : ইতালিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে গড়ে প্রতি বছর একটি নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। এই রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করেছে।
নীতিগত ধারাবাহিকতার অভাব : সরকারের ঘন ঘন পরিবর্তন মানে নীতিগত ধারাবাহিকতার অভাব, যা বিনিয়োগ এবং দীর্ঘমেয়াদী সংস্কার বাস্তবায়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।
রাজনৈতিক দূষণ : দুর্বল জোট সরকার এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা দুর্নীতির পথ খুলে দিয়েছিল, কারণ দলগুলো ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন আপস এবং অনৈতিক বোঝাপড়া করতো।
সংশোধন : ১৯৯০-এর দশকে ইতালি তার নির্বাচন ব্যবস্থায় আংশিক সংস্কার এনে মিক্সড-মেম্বার প্রপোর্শনাল (MMP) পদ্ধতির মতো একটি হাইব্রিড সিস্টেম গ্রহণ করে, যা কিছু স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছে।
৪. পেরু
পেরুতে পিআর ব্যবস্থা, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট শাসিত ব্যবস্থায়, কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।
কেন ব্যর্থ/চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন?
পেরুর পিআর ব্যবস্থায় কংগ্রেস (সংসদ) অত্যন্ত খণ্ডিত হয়ে পড়ে, যেখানে প্রেসিডেন্টকে প্রায়শই শক্তিশালী বিরোধী দলীয় জোটের মুখোমুখি হতে হয়।
পরিণতি
নির্বাহী-আইনসভা অচলাবস্থা : প্রেসিডেন্টের (নির্বাহী বিভাগ) এবং কংগ্রেসের (আইনসভা) মধ্যে প্রায়ই তীব্র সঙ্ঘাত দেখা যায়। কারণ তারা ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করে এবং একে অপরের প্রতি আস্থাহীন থাকে। এর ফলে রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি হয়।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পেরুতে প্রেসিডেন্ট এবং কংগ্রেসের মধ্যে তীব্র ক্ষমতা যুদ্ধ দেখা গেছে, যার ফলে বেশ কয়েকজন প্রেসিডেন্টকে অভিশংসন করা হয়েছে বা পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। এটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে।
৫. গ্রীস
গ্রীসে পিআর পদ্ধতির একটি মিশ্র রূপ রয়েছে। এই ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া দলকে পার্লামেন্টে একটি বোনাস সিট দেয়া হয়, যা তাদের সরকার গঠনে সাহায্য করে। তবে এই পদ্ধতিও সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
কেন ব্যর্থ?
যদিও এই বোনাস সিট ব্যবস্থা কিছুটা স্থিতিশীলতা দিতে চেয়েছিল, কিন্তু তারপরও গ্রীসের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে অস্থিতিশীলতা দেখা গেছে। পিআর ব্যবস্থার কারণে ছোট দলগুলো প্রায়শই ‘কিংমেকার’ এর ভূমিকা পালন করে।
পরিণতি
ঋণ সংকটের সময় অকার্যকর সরকার: গ্রীস যখন তার গুরুতর আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন পিআর ব্যবস্থার কারণে গঠিত জোট সরকারগুলো প্রায়শই প্রয়োজনীয় কঠিন অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছিল।
জনতুষ্টি রাজনীতি : বোনাস সিট ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও, দলগুলো প্রায়শই জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য এমন প্রতিশ্রুতি দিত যা বাস্তবসম্মত ছিল না। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক সংকট আরও গভীর হয়েছিল।
রাজনৈতিক অচলাবস্থা : জোটের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধের কারণে পার্লামেন্টে গুরুত্বপূর্ণ বিল পাস করা কঠিন হয়ে যেত, যা দেশের শাসন ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছিল।
৬. আর্জেন্টিনা
আর্জেন্টিনার সংসদীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় পিআর পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যা দেশটিকে প্রায়শই রাজনৈতিক বিভাজন এবং অচলাবস্থার দিকে নিয়ে গেছে।
কেন ব্যর্থ?
ফ্র্যাগমেন্টেড পার্লামেন্ট: পিআর ব্যবস্থার কারণে পার্লামেন্ট প্রায়শই বহু দলীয় খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে প্রেসিডেন্টের জন্য পার্লামেন্টের সমর্থন পাওয়া কঠিন হয়ে যায়, যা তাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি বাস্তবায়নে বাধা দেয়।
নির্বাহী-আইনসভা সংঘাত: প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতা এবং একটি খণ্ডিত আইনসভার মধ্যে প্রায়শই তীব্র সংঘাত দেখা যায়। এর ফলে শাসন ব্যবস্থায় অকার্যকরতা (gridlock) তৈরি হয়, যা অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থতার একটি কারণ হিসেবে দেখা হয়।
রাজনৈতিক পোলারাইজেশন: এই পদ্ধতি রাজনৈতিক মেরুকরণকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে, যেখানে দলগুলো পরস্পরের সাথে কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করে।
৭. শ্রীলঙ্কা
শ্রীলঙ্কায় ১৯৭৮ সালে ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট (FPTP) পদ্ধতির পরিবর্তে পিআর পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। এর লক্ষ্য ছিল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ দেয়া।
কেন ব্যর্থ?
সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বে ব্যর্থতা: যদিও পিআর পদ্ধতির উদ্দেশ্য ছিল সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে যে নির্বাচিত সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিরা প্রায়শই নিজেদের সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার পরিবর্তে রাজনৈতিক সুবিধা এবং পদ-পদবীর জন্য ক্ষমতাসীন দলের সাথে যোগ দিয়েছে।
দলীয় দল-বদলের সুযোগ: এই ব্যবস্থায় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের দলের বা ভোটারদের প্রতি দায়বদ্ধ না হয়ে রাজনৈতিক দল-বদলের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সুযোগ পায়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিরা তাদের নির্বাচনী এলাকার ম্যান্ডেট লঙ্ঘন করে মন্ত্রিসভার পদ পাওয়ার জন্য দল পরিবর্তন করে।
কার্যকর জবাবদিহিতার অভাব: যেহেতু ভোটাররা সরাসরি প্রার্থীকে নির্বাচিত করে না, তাই তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির জবাবদিহিতা কমে যায়। এটি জনগণের আস্থা হ্রাস করে।
৮. ভেনিজুয়েলা
ভেনিজুয়েলায়ও পিআর পদ্ধতির একটি সংস্করণ ব্যবহার করা হয়, তবে এটি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং চরম মেরুকরণের কারণ হয়েছে।
কেন ব্যর্থ?
চরম রাজনৈতিক বিভাজন: পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচিত সংসদ চরমভাবে বিভাজিত হয়েছে, যেখানে ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দল একে অপরের প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করে। এর ফলে কোনো ধরনের অর্থপূর্ণ সংলাপ বা সমঝোতা অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা: ভেনিজুয়েলার রাজনৈতিক সংঘাত প্রায়শই আইনসভা (সংসদ) এবং নির্বাহী বিভাগের (প্রেসিডেন্ট) মধ্যে ক্ষমতা যুদ্ধের রূপ নিয়েছে। পিআর ব্যবস্থার কারণে খণ্ডিত পার্লামেন্ট প্রেসিডেন্টের নীতি বাস্তবায়নে বাধা দিয়েছে, যা শাসন ব্যবস্থাকে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছে।
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা: পিআর পদ্ধতি কার্যকরভাবে কাজ করার জন্য শক্তিশালী ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। ভেনিজুয়েলায় এই প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হওয়ায় পিআর ব্যবস্থা শুধুমাত্র রাজনৈতিক সংঘাতকে আরও তীব্র করেছে।
এই উদাহরণগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে পিআর পদ্ধতি, যদিও এটি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে, কিন্তু যদি এর সাথে কার্যকর থ্রেশহোল্ড না থাকে, বা এটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তবে এটি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সরকারের ঘন ঘন পতন, চরমপন্থী দলের উত্থান এবং নীতি নির্ধারণে অচলাবস্থা সৃষ্টি করতে পারে। আর এমনটা হলে আখেরে কার লাভ হবে? আমাদের চির বৈরি ভারতের। এই রাজনীতিও যদি না বোঝেন তাইলে আপনাদের প্রতি করুণা করা ছাড়া কিছু করার নাই।
লেখকের ফেসবুক পোস্ট থেকে নেয়া