সম্পাদকীয় ডেস্ক, টুডে নিউজ
এনসিপির রাজনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা তাদের আদর্শিক অবস্থানের ভঙ্গুরতা। দলটি কখনো মুসলিম জাতীয়তাবাদের সুরে কথা বলে, আবার কখনো বাঙালি জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এমন চাহিদাভিত্তিক রাজনৈতিক কাঠামো এনসিপিকে আদর্শগতভাবে অস্পষ্ট করে তোলে। এক সময় তারা মুসলিম জাতীয়তাবাদকে আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে কার্যকর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ব্যবহার করে জনপ্রিয়তা পেলেও, পরে তা ধরে রাখতে পারেনি।
বিএনপি প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠার পর “মাইনাস টু” ন্যারেটিভ চালাতে গিয়ে তারা জেনজির উপর নির্ভর করে। কিন্তু জেনজির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি মিম ও প্রবণতানির্ভর হওয়ায় এনসিপির তাত্ত্বিক অবস্থান সেখানে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ফলে তারা সেই ন্যারেটিভ থেকে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়।
এনসিপি গঠনের আগেই দলটির চারপাশে বিতর্ক তৈরি হয়। এক্স-শিবিরদের বাদ দিয়ে সংগঠন গড়ার চেষ্টা এবং এর সাথে মুনতাসির ইস্যু ও দুর্নীতির অভিযোগ দলটির জন্য বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়ায়। এই সময়েই ’৪৭ সালকে কেন্দ্র করে আদর্শিক বিভ্রান্তিও সামনে আসে। শুরুতে ’৪৭ বাদ দিয়ে পোস্টার প্রকাশ এবং পরে তা যোগ করার ঘটনা জনমনে সন্দেহ তৈরি করে। মুসলিম কর্তাসত্তা নিয়ে কথা বললেও, পরবর্তীতে হিন্দুপ্রভাবিত বাঙালি জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকে যাওয়া তাদের অবস্থানকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
জামায়াত ইস্যুতেও এনসিপিকে ভোলাটাইল ভূমিকা নিতে দেখা গেছে। তাদের কোনো কোনো নেতাকে জামায়াতকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোর অংশ হিসেবে মেনে নিতে দেখা গেলেও, পরে আবার যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তুলতেও দেখা যায়। বিশেষ করে ছাত্রসংগঠনের কিছু অংশ আওয়ামী লীগের ভাষায় কথা বলতে শুরু করে এবং হুমকির রাজনীতি করে। এতে এনসিপির অবস্থান আরও অস্পষ্ট হয়ে পড়ে।
“নতুন বন্দোবস্ত” রেটরিকও এনসিপিকে সাহায্য করতে পারেনি। এই ধারণাকে কেন্দ্র করে শোডাউন, দুর্নীতির অভিযোগ এবং আওয়ামী পুনর্বাসনের আশঙ্কা দলটির ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই ভোলাটাইল অবস্থান তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
এনসিপির এই অস্থির অবস্থানের মধ্যেও হাসনাত আবদুল্লাহ একজন ব্যতিক্রমী চরিত্র হিসেবে উঠে আসেন। ইসকন ইস্যুতে অবস্থান, রিফাইন্ড আওয়ামী ষড়যন্ত্র ফাঁস, ইসলামপন্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং এককভাবে আওয়ামী নিষিদ্ধের ডাক দিয়ে তিনি নিজেকে আলাদা করে তুলেছেন। তিনি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন যে, তার ডাকেই মানুষ রাজপথে নেমেছে—এমনকি ইসলামপন্থীরাও। প্রশ্ন থেকে যায়, এনসিপি যদি হাসনাতকে হারায়, তবে মাঠের রাজনীতি করার মতো নেতৃত্বও তারা হারাবে।
সাংগঠনিক কাঠামোর দিক থেকেও এনসিপি দুর্বল হয়ে পড়েছে। কোরাম-নির্ভর রাজনীতি এবং মাইনাস গেমের কারণে তাদের জনসম্পৃক্ততা হ্রাস পেয়েছে। রাজনৈতিক জোট ও সহযোগিতাও তারা হারিয়ে ফেলেছে। আর আদর্শিক দোদুল্যমানতা তো রয়েছেই।
সব মিলিয়ে বলা যায়, এনসিপি এখন এক গভীর রাজনৈতিক সংকটে রয়েছে। তাদের আদর্শিক অস্পষ্টতা, জনপ্রিয় নেতৃত্বের অভাব, সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক একাকিত্ব তাদেরকে ধীরে ধীরে খাদের কিনারায় নিয়ে এসেছে। ছাত্র রাজনীতির যে শক্তি গণঅভ্যুত্থানের সময় প্রাণভোমরার ভূমিকা রেখেছিল, তার এই বিলীন হয়ে যাওয়া সত্যিই দুঃখজনক। “নতুন বাংলাদেশ”–এর স্বপ্নও হয়তো ক্রমেই মলিন হয়ে যাচ্ছে।