পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে সংশোধিত ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদ থেকে যে সহিংসতার সূচনা হয়েছিল, সোমবার পর্যন্ত তা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে দাবি করেছে পুলিশ। তবে এই নিয়ন্ত্রণের মাঝেই জাফরাবাদে নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণার ভাঙ্গরে পুলিশের লাঠিচার্জ, পরিস্থিতির গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। প্রশ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে- ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদ কেন সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় রূপ নিলো মুর্শিদাবাদে?
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, এই সহিংসতা যে মুর্শিদাবাদের গ্রামীণ অঞ্চল সুতি ও সামশেরগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে, তা রাজ্যের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এক ব্যতিক্রম ঘটনা। শনিবারের ঘটনায় তিনজন প্রাণ হারান এবং বহু হিন্দু পরিবার নিরাপত্তার অভাবে মালদা ও ঝাড়খণ্ডে পালিয়ে যান। কেন্দ্রীয় বাহিনী ও রাজ্য পুলিশ যৌথ টহলে নিয়োজিত হলেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে- এই হিংসা কি নিছক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, নাকি এর পেছনে গভীর রাজনৈতিক কৌশল কাজ করেছে? তা না হলে ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদ কেন সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় রূপ নিলো মুর্শিদাবাদে?
আরো পড়ুন :
বিজেপির ‘এক দেশ এক ধর্ম’ বাস্তবায়নে চরম সঙ্কটে মুসলিমরা
উত্তরাখণ্ডে ১৭০টির বেশি মাদরাসা সিলগালা
ভারতের নন্দনগরে মুসলিম নিধন, শহরের সর্বশেষ মুসলিম দম্পতির নিদারুণ লড়াই
গ্রামে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, অস্বাভাবিক বার্তা
গ্রামবাংলায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, পাড়াপ্রতিবেশিত্ব, কৃষিকাজে নির্ভরতা-সব মিলিয়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সেখানে প্রায় অদৃশ্য। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শহরে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি যতটা সরব, গ্রামে তার প্রতিফলন এতদিন দেখা যায়নি। তাই শনিবারের ঘটনা ব্যতিক্রমী এবং চিন্তার বিষয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রথমবারের মতো মুর্শিদাবাদের মতো এক শান্তিপূর্ণ কৃষিপ্রধান এলাকায় ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়া ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এটি পরিকল্পিতও হতে পারে।
কারা উস্কে দিলো, কেন?
প্রতক্ষ্যদর্শীরা বলছেন, সহিংসতার সময় এলাকায় বহু ‘অপরিচিত মুখ’ দেখা গেছে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সূত্র এবং রাজ্যের মুসলিম নেতৃত্বের একটি অংশও মনে করছেন, বাইরের কিছু সংগঠন ও ব্যক্তিরা এই উত্তেজনায় ইন্ধন দিয়েছে। এমনকি কেরলভিত্তিক একটি সংগঠনের নাম ঘুরে বেড়াচ্ছে, যারা পশ্চিমবঙ্গে সংগঠন খুলে ভোটে দাঁড়ালেও কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।
রাজ্যের সংখ্যালঘু উন্নয়নমন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর মন্তব্য, ‘যারা এটা করছেন, তারা সাবধান হোন, আল্লাহর হুকুমের বিরোধিতা করছেন’- এই বার্তায় স্পষ্ট তার ক্ষোভ। ওয়াকফ আইন নিয়ে প্রতিবাদ করা এক কথা। কিন্তু তাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়া যেন গোটা আন্দোলনের নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
আন্দোলনের দিকচক্রবাল পরিবর্তন?
পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের সভাপতি মুহম্মদ কামরুজ্জামান স্পষ্ট করেই বলেছেন, এই আন্দোলন কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয়, এটি কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে। অথচ ঘটনাবলীর এমন বাঁক নেয়া আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য ও গ্রহণযোগ্যতাকেই বিপন্ন করছে। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কেন প্রথমেই শান্তির বার্তা নিয়ে সামনে এলেন না? ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদ কেন সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় রূপ নিলো মুর্শিদাবাদে?
নির্বাচনী রাজনীতির ছায়া?
আগামী বছর রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। তার প্রাক্কালে এই ধরনের উত্তেজনা অনেক বড় প্রশ্ন তুলছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অমল সরকার বলেন, গত কয়েক মাসে ধর্মীয় মেরুকরণের পটভূমি তৈরি হচ্ছিল। বিধানসভায় ধর্মভিত্তিক বক্তব্যের প্রবণতা সেই ইঙ্গিতই দেয়।
একটি বিশেষ দল ও তার সহযোগী সংগঠনরা যেভাবে ধর্মীয় আবেগকে রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করে এসেছে, তা রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের অজানা নয়। রাজ্যের বাইরে থেকে সংগঠন এনে মুর্শিদাবাদের মত শান্তিপূর্ণ গ্রামীণ অঞ্চলে উত্তেজনা ছড়ানো সেই পরিচিত ছকেরই অংশ কি না, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
সূত্র : বিবিসি