ওয়াকফ বিল এনে মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকারে আঘাত কেন?

টুডেনিউজ বিডি ডটনেট

২০১৪ সালে থেকে দেশে বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে। তখন থেকেই কিভাবে দেশের মুসলিম সম্প্রদায়কে ‘টাইট’ দেয়া যায়, তার নিত্যনতুন পন্থা বের করা হচ্ছে এবং তা একে একে রূপায়ণ করা হচ্ছে। শুরু হয়েছে ‘তিন তালাক’ প্রথা রদ করা দিয়ে। এরপর কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদ, মুসলিম নামাঙ্কিত বিভিন্ন স্থানের নতুন করে নামাঙ্কন করা, ইসলাম ধর্মাচরণে নানাভাবে বাধা দেয়া, কিছু রাজ্যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করা ইত্যাদির পর এবার কেন্দ্রীয় সরকারের লক্ষ্য হলো ওয়াকফ সম্পত্তি।

যে ওয়াকফ পুরোপুরি ইসলাম ধর্মের রীতিনীতি মেনে গড়ে উঠেছে, যার সূত্রপাত হয়েছিল খলিফা উমরের হাত ধরে।
সেই ধর্মীয় ভাবাবেগের তোয়াক্কা না করে বুধবার লোকসভায় ওয়াকফ সংশোধনী বিল পেশ করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজু। বিরোধীদের তুমুল প্রতিবাদ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে মন্ত্রী রিজিজু জানিয়ে দিয়েছেন, এই বিল তারা পাশ করাবেনই।

রিজিজু যে কথা জানিয়েছেন লোকসভায় তা থেকে পরিস্কার মুসলিমদের হাত থেকে ওয়াকফ ছিনিয়ে নিতেই এই সংশোধনী বিল এনেছে সরকার। কারণ, পুরনো বিলের ৪০ ধারা বদলে নতুন বিলে বলা হয়েছে, ওয়াকফ বোর্ড আগের মতো যেকোনো জমি ওয়াকফের বলে ঘোষণা করতে পারবে না। তাছাড়া ওয়াকফ বোর্ডে এবার থেকে চারজন অমুসলিম সদস্যও থাকবেন। থাকবেন মহিলা সদস্যও। শিয়া, সুন্নি, বোহরা এবং অনগ্রসর মুসলিমদের প্রতিনিধিরা থাকবেন বোর্ডে। এভাবে মুসলিমদের মধ্যে ভাগাভাগির রাজনীতি করা হলো এই সব ধারা এনে।

রিজিজুর দাবি, ওয়াকফের যে সব সম্পত্তি রয়েছে, তার বেশিরভাগই ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তা ওয়াকফ সম্পত্তি থেকে বাদ দেয়া হবে।

ইউপিএ আমলে দিল্লির নোটিফায়েড অথরিটির আওতাধীন যে ১২৩টি সম্পত্তি ওয়াকফের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল তা যে কেন্দ্র ওয়াকফের হাত থেকে নিয়ে নেবে সেকথা বেশ গর্বের সাথে ঘোষণা করে বলেন, এসব সম্পত্তি ওদের হাতে চলে গিয়েছিল, সংসদ ভবন পর্যন্ত দখল করে নিতো ওরা, প্রধানমন্ত্রী মোদি তা বাঁচিয়েছেন।

আরো বলা হয়েছে, আদিবাসী কল্যাণের নামে কোনো জমি ওয়াকফ সম্পত্তি বানানো যাবে না। মোটমাট সব দিক থেকে ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা খর্ব করে বোর্ডের হাতে থাকা বিপুল সম্পত্তি যে কেন্দ্র আগামী দিনে হুকুম-দখল করবে তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। অথচ ইসলাম ধর্ম অনুসারে কোনো স্থানান্তরযোগ্য এবং অস্থানান্তরযোগ্য জমি বা সম্পত্তি পবিত্র ধর্মীয় এবং দাতব্য কাজে ব্যবহার করার জন্য আল্লাহর উদ্দেশে সমর্পণ করা সম্পদ ওয়াকফ সম্পদ বলে গণ্য হয়।

আরবি শব্দ ‘ওয়াকুফা’ থেকে ওয়াকফ শব্দটি এসেছে। ওয়াকুফার অর্থ হল ‘হেফাজতে রাখা’। মুসলিমদের মসজিদ, এতিমখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি জনমুখী কাজের জন্য ওয়াকফ বোর্ডের সূত্রপাত হয়। এতকাল নিয়ম ছিল, একবার ওয়াকফের জন্য কোনো সম্পত্তি উৎসর্গ করা হলে তা আর হস্তান্তর, দান বা বিক্রি করা যাবে না। ১৯৯৫ সালে ওয়াকফ আইন সংশোধন করে প্রত্যেক রাজ্যে পৃথক ওয়াকফ বোর্ড গড়ার কথা বলা হয়েছিল। দেশের বহু ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে বহু মামলা ঝুলে রয়েছে আদালতে। কেন্দ্র এক ঢিলে সব পাখি মারার উদ্দেশে এমন বিল আনল যে এবার সব মামলারই আপন নিয়মে অবসান হয়ে যাবে। যেমন, উত্তরপ্রদেশে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড ২০০৫ সালে জানিয়েছিল, তাজমহল ওয়াকফ সম্পত্তি। কেন্দ্রীয় পুরাতত্ত্ব পর্ষদ সাথে সাথে দাবি করে যে তাজমহল দেশের প্রাচীন পুরাতত্ত্ব আইনের আওতাধীন সম্পত্তি। এই দাবিকে নস্যাৎ করে ওয়াকফ বোর্ড সুপ্রিম কোর্টে যায়। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, মুঘলসম্রাট শাহজাহান যে নথিতে তাজমহলকে ওয়াকফ এর হাতে দেন সেই নথি পেশ করা হোক আদালতে। অত পুরাতন নথি পাওয়া যায়নি এখনো। স্বাভাবিকভাবে সুপ্রিম কোর্টে মামলা ঝুলেই রয়েছে। এমন অনেক মামলা রয়েছে।

সংসদের দুই কক্ষে সংখ্যাধিক্যের সুবাদে ওয়াকফ সংশোধনী আইন যে পাশ হয়ে আইন হয়ে যাবে তা বিজেপি বিলক্ষণ জেনেই বিল পেশ করেছে। কিন্তু এক ধর্মের বিধান, যার সাথে আল্লাহর নাম জড়িয়ে রয়েছে, কারণ ওয়াকফ সম্পত্তি উৎসর্গ করা হয় তাঁরই নামে, সংসদীয় কানুনের মোড়কে নস্যাৎ করে দেয়া কি ঠিক? দেশে প্রত্যেক ধর্মের স্বাধীন ধর্মাচরণের কথা বারবার বলা হয়। অথচ এসব কানুন কি দেশের সাংবিধানিক কাঠামোর প্রধান সুরকে প্রতিহত করে না? এসব কথা ভাবার সময় এসেছে।

বুধবার সব বিরোধী দলের সাংসদেরা সেকথাই স্মরণ করিয়ে দিলেন সরকারকে এবং বিশেষ করে বিল পেশকারী মন্ত্রী কিরেন রিজিজুকে। কিন্তু বিজেপির ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব। কোনো বিরোধিতাকেই তারা আমল দিতে নারাজ। এই আইন পাশ করানোর পরই কেন্দ্র যে একের পর এক ওয়াকফ সম্পত্তি সরকারি উন্নয়নমূলক কাজের কথা বলে নিজ হাতে নেবে তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে ভালোভাবেই। এটা ঠিক, ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে।

ওয়াকফকে কুক্ষীগত করার এই বিল দেশের সংখ্যলঘু সম্প্রদায়ের বৃহৎ অংশকে বিচলিত করবে, ক্ষুব্ধ করবে, নিজ অস্তিত্ব নিয়ে ভীতির বাতাবরণে পৌঁছতে বাধ্য করবে। সেই কারণেই এই বিল, যা আগামী দিনে আইন হতে চলেছে, পেশ করার আগে সরকার গভীরভাবে ভাবনা-চিন্তা করতে পারতো। দেশের মুসলিম আলেমরা কী বলছেন, তা বিবেচনার মধ্যে আনতে পারতো। কিন্তু তা করবে কেন? একটি সম্প্রদায়কে ‘টাইট’ দেয়াই তো মুখ্য উদ্দেশ্য।

সূত্র : পুবের কলম

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top