দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেওয়ার ঘোষণা যখন এল, তখন অনেকেই ভেবেছিল—অবশেষে কওমি শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ হলো। এত বছর পর কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে এক বড় অর্জন। কিন্তু স্বীকৃতির ঘোষণা এলেও বাস্তব প্রয়োগ আজও ধোঁয়াশায় রয়ে গেছে।
গেজেট প্রকাশের পর স্বাভাবিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল, কওমি শিক্ষার্থীরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে, সরকারি চাকরিতে সুযোগ পাবে, মূলধারার শিক্ষাজগতে সম্মানের সঙ্গে স্থান করে নেবে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং চাকরির ক্ষেত্রগুলো এখনো এই স্বীকৃতিকে পুরোপুরি মেনে নিচ্ছে না।
সমস্যার মূল জায়গাটা হলো—ঘোষণার পর কোনো সুস্পষ্ট কাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। কোথাও ভর্তি নীতিমালা তৈরি হয়নি, কোথাও চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় গাইডলাইন নেই। অনেক জায়গায় এখনো বোঝাপড়া নেই—দাওরায়ে হাদিস আসলে কী পরিমাণ দক্ষতা ও জ্ঞান প্রদান করে। ফলে যারা এই সনদ নিয়ে বের হচ্ছেন, তারা পড়াশোনার পর উচ্চশিক্ষায় যেতে পারছেন না, চাকরির সুযোগও পাচ্ছেন না।
অনেকে প্রশ্ন তোলেন—কওমি ছাত্রদের তো বিজ্ঞান, গণিত, ইংরেজির মতো বিষয়গত জ্ঞান নেই, তারা কিভাবে প্রতিযোগিতায় টিকবে? এমন প্রশ্ন পুরোপুরি অযৌক্তিক না হলেও বাস্তবতা অনেকটা ভিন্ন। এখন অনেক কওমি মাদরাসায় অষ্টম বা দশম শ্রেণি পর্যন্ত এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত আছে। অনেক প্রতিষ্ঠান নতুন পাঠ্যক্রম যুক্ত করে শিক্ষার্থীদের আরও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছে।
এমনকি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চাতেও কওমি শিক্ষার্থীরা গত দুই দশকে অনেক অগ্রগতি করেছে। একসময় হয়তো পিছিয়ে ছিল, কিন্তু এখন বলা যাবে না যে তারা একেবারে বঞ্চিত বা অযোগ্য। বরং রাষ্ট্র যদি একটি সেতুবন্ধন তৈরি করে, তাহলে এই শিক্ষার্থীরাই ইসলামিক স্টাডিজ, আরবি সাহিত্য, ইসলামের ইতিহাস কিংবা ফারসি ও উর্দুর মতো বিভাগগুলোকে নতুন প্রাণ দিতে পারে।
সমাধানের পথও কঠিন কিছু নয়। প্রয়োজন হলে ৬ মাস বা এক বছরের প্রস্তুতিমূলক কোর্স চালু করা যেতে পারে, যেখানে তারা মূলধারার বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো শিখে নিতে পারবে। এর ফলে তারা অনায়াসে মাস্টার্স বা গবেষণার পর্যায়ে যুক্ত হতে পারবে।
সরকারি চাকরিতেও সমানভাবে সুযোগ থাকা জরুরি। ধর্ম মন্ত্রণালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বিভিন্ন মসজিদ, স্কুল বা প্রজেক্টে কওমি শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করলে সমাজ উপকৃত হবে। প্রয়োজনে নির্বাচনী পরীক্ষা নিয়ে যোগ্যদের বেছে নেওয়া যেতে পারে।
চাইলেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোটাসহ ভর্তির সুযোগ করে দেওয়া সম্ভব। প্রয়োজনে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে শ্রেণিভিত্তিক বিন্যাস তৈরি করে বিষয়গুলো আরও কাঠামোগত করা যায়। আবার বিকল্প হিসেবে দাওরাকে মাস্টার্স না রেখে অনার্স সমমান ধরেও অনেক বেশি ব্যবহারিক সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। এতে করে তারা আরও সহজে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পারবে এবং একটি পরিষ্কার পথ তৈরি হবে।
সবশেষে বলা যায়—স্বীকৃতির ঘোষণা এক জিনিস, আর বাস্তবায়ন একেবারে ভিন্ন। শুধু কথায় নয়, বাস্তব পদক্ষেপেই এই স্বীকৃতিকে অর্থবহ করতে হবে। তা না হলে এই অর্জন একটা রাজনৈতিক স্লোগান হয়েই থেকে যাবে, যার সঙ্গে কওমি শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের খুব বেশি সম্পর্ক থাকবে না।