টিআরএফ, পেহেলগাম, কাশ্মির

কাশ্মিরে পর্যটক হত্যাকাণ্ড : দায় স্বীকারকারী টিআরএফ কে এবং কেন এই হামলা?

ভারত-শাসিত কাশ্মিরে পর্যটকদের উপর গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার দায় স্বীকার করেছে স্বল্প পরিচিত সশস্ত্র গোষ্ঠী দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ)। মঙ্গলবার বিকেলে কাশ্মিরের পেহেলগামে সংঘটিত এ হামলায় কমপক্ষে ২৬ জন পুরুষ পর্যটক নিহত হন। এছাড়া আরো এক ডজনের বেশি আহত হন। এই হত্যাকাণ্ড শুধু কাশ্মিরের নিরাপত্তা পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে, তা-ই নয়। বরং ভারতীয় প্রশাসনের জন্যও নতুন চ্যালেঞ্জের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

কাশ্মিরে হামলা : কলকাতা ডিজিটাল মিডিয়া ফেডারেশনের কো-ফাউন্ডারের ৯ অভিযোগ

ঘটনার বিবরণ

পেহেলগামের বৈসারান তৃণভূমিতে এক মনোরম বিকেলে হঠাৎ নিকটবর্তী বন থেকে বন্দুকধারীরা এসে পর্যটকদের উপর গুলি চালায়। এতে নিহতদের সবাই পুরুষ।

হামলার পরপরই ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ শ্রীনগরে যান। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, এই জঘন্য কাজের পেছনে যারা রয়েছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে … তাদের রেহাই দেয়া হবে না!। একইসাথে বিশ্ব নেতারা, যেমন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন শোকবার্তা পাঠান।

টিআরএফ কে?

২০১৯ সালে কাশ্মিরের আংশিক স্বায়ত্তশাসন বাতিলের পর গঠিত হয় দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট। প্রাথমিকভাবে এটি টেলিগ্রামে বার্তা ছড়িয়ে ভার্চুয়াল ফ্রন্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কাশ্মির পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে বসতি স্থাপন এবং স্থায়ী অবস্থানের মর্যাদা দেয়ার বিরোধিতায় এই গোষ্ঠীটির উত্থান ঘটে।

টিআরএফ-এর বার্তায় বলা হয়েছে, তারা বহিরাগতদের বসতি স্থাপনের বিরোধিতা করে। কারণ, এটি কাশ্মিরের জনসংখ্যাগত কাঠামো পরিবর্তনের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যদিও সর্বশেষ হামলার শিকাররা পর্যটক; তারা কাশ্মিরে স্থায়ীভাবে বসতি গড়েননি; তবুও গোষ্ঠীটির সহিংস অবস্থান নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল না।

গোষ্ঠীটির নামও কৌশলগতভাবে নির্বাচিত, যাতে ধর্মীয় চিহ্ন না থেকে কাশ্মিরি জাতীয়তাবাদের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা যায়। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিশ্বাস করে, টিআরএফ পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বার একটি শাখা। যদিও পাকিস্তান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে তারা কেবল কাশ্মিরি জনগণকে কূটনৈতিক ও নৈতিক সহায়তা প্রদান করে। ইসলামাবাদ পেহেলগাম হামলারও নিন্দা জানিয়েছে।

কিছু ভারতীয় কর্মকর্তা মনে করেন, মূল হামলাটি হয়তো লস্কর-ই-তৈয়বা করেছে, টিআরএফ কেবল দায় স্বীকার করে ভারতের তদন্ত প্রক্রিয়াকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে।

টিআরএফ-এর অতীত কর্মকাণ্ড

২০২০ সালের মধ্যেই টিআরএফ ছোটখাটো উগ্রবাদী হামলার দায় নিতে শুরু করে, যার মধ্যে টার্গেট কিলিংও অন্তর্ভুক্ত ছিল। গোষ্ঠীটির যোদ্ধারা বিভিন্ন বিভক্ত বিদ্রোহী গোষ্ঠী থেকে আসা এবং ভারতীয় বাহিনীর একাধিক অভিযানে বহু টিআরএফ সদস্য নিহত হয়েছে।

এতদসত্ত্বেও টিআরএফ ধীরে ধীরে শক্তি বৃদ্ধি করেছে। ২০২২ সাল নাগাদ কাশ্মিরে যেসব সশস্ত্র যোদ্ধা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়, তাদের বড় অংশই টিআরএফ-এর সাথে যুক্ত ছিল। এই গোষ্ঠীটি পিস্তলের মতো ছোট অস্ত্র দিয়ে অবসরপ্রাপ্ত নিরাপত্তা কর্মী এবং তথাকথিত তথ্যদাতাদের টার্গেট করে হত্যার কৌশল গ্রহণ করে।

এক সময় তারা কাশ্মিরি সাংবাদিকদের বিশ্বাসঘাতক হিট লিস্ট-এ নাম তুলে ভয়ভীতি ছড়ায়, যার পরিণতিতে কমপক্ষে পাঁচজন সাংবাদিক পদত্যাগ করেন। উল্লেখযোগ্যভাবে, ২০১৮ সালে সুজাত বুখারি নামক বিশিষ্ট সাংবাদিককে শ্রীনগরে হত্যা করা হয়, যার পেছনে লস্কর-ই-তৈয়বার সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছিল।

সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুনে টিআরএফ জম্মুর রিয়াসিতে একটি তীর্থযাত্রীদের বাসে হামলার দায়ও স্বীকার করে, যেখানে বাসটি খাদে পড়ে অন্তত ৯ জন নিহত এবং ৩৩ জন আহত হন।

টিআরএফ কিভাবে আলাদা?

টিআরএফ তাদের প্রাণঘাতী আক্রমণের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে। তারা পুরনো ও নতুন কৌশলের মিশ্রণ ব্যবহার করেছে। এর ইংরেজি নাম ছিল ভিন্নধর্মী, তেমনই ছিল এর সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার। তবে অন্য অনেক দিক থেকে এটি ছিল অনেক বেশি ঐতিহ্যবাহী কৌশলের উপর নির্ভরশীল।

টিআরএফ আসার আগে, ২০১৪ সাল থেকে কাশ্মিরি বিদ্রোহী কমান্ডাররা ক্রমশ আরো বেশি জনসাধারণমুখী চরিত্র ধারণ করতে শুরু করে। তারা নিজেদের ভিডিও আপলোড করতো- কখনো আপেল বাগানে হাঁটছেন, কখনো ক্রিকেট খেলছেন কিংবা বাইকে চড়ে শ্রীনগরে ঘুরছেন। এই সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারণা বিদ্রোহী দলে সদস্য সংগ্রহে বড় ভূমিকা রাখে। এ ধরনের কৌশলের অন্যতম উদাহরণ ছিলেন বুরহান ওয়ানি, যার ২০১৬ সালের জুলাই মাসে হত্যার ফলে এক গণ-বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে ১০০-র বেশি বেসামরিক নিহত হন।

কিন্তু ২০১৯ সালের কঠোর অভিযানের পর ওই কৌশল কার্যকরিতা হারায়। তখন নতুন করে আত্মপ্রকাশ করা টিআরএফ আগের পরীক্ষিত পদ্ধতিতেই ফিরে যায়। পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মুখগুলো আবার আড়াল হয়ে যায়; হামলার সংখ্যা কমলেও তীব্রতা আরো বেড়ে যায়।’

মোহাম্মদ আব্বাস শেখ, যিনি ১৯৯৬ সালে বিদ্রোহে যোগ দেন বলে জানা যায়, তার নেতৃত্বে টিআরএফ শ্রীনগরে হামলা পরিচালনা করে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ২০২১ সালে আব্বাস শেখ নিহত হন। পরের বছর আরো অনেক বিদ্রোহী নিহত হওয়ার পর টিআরএফ পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়।

২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ভারত সরকার টিআরএফ-কে একটি উগ্রবাদী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করে। ওই ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়, সংগঠনটি কাশ্মিরে অস্ত্র পাচার এবং সদস্য সংগ্রহে পাকিস্তানের সহায়তা নিচ্ছে।

নিরাপত্তা বাহিনী যত বেশি টিআরএফ যোদ্ধাকে হত্যা করছে, তাদের সংখ্যা তত কমে আসছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্র মতে, বিদ্রোহীরা প্রশিক্ষিত হলেও বর্তমানে মূলত উচ্চভূমির আস্তানায় অবস্থান করছে।

মোদির কাশ্মির নীতির জন্য এই আক্রমণের তাৎপর্য কী?

যদিও ভারতীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে এই হামলা অপ্রত্যাশিত ছিল। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এটি মোদি সরকারের কাশ্মির নীতির অন্তর্নিহিত ত্রুটির বহিঃপ্রকাশ।

২০১৯ সালে কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর প্রধানমন্ত্রী মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বারবার ‘স্বাভাবিকতা’ ফিরিয়ে আনার দাবি করে আসছেন।

সরকারের এই আশ্বাস ও পর্যটনের প্রচারণাই গুজরাটের জামনগরের বাসিন্দা কৈলাস শেঠিকে তার পরিবারসহ কাশ্মিরে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এখন তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অঞ্চলটি ছেড়ে যেতে চান।

শেঠি আল জাজিরাকে বলেন, ‘আমরা মাত্র দু’দিন আগে পেহেলগামে ছিলাম, যেখানে হামলা হয়েছে। আমি আপনাকে বোঝাতে পারব না যে আমি এখন কতটা আতঙ্কিত। আমি শুধু আমার পরিবারকে নিয়ে এখান থেকে চলে যেতে চাই।’

বুধবার আতঙ্কে পর্যটক ও ট্যুর অপারেটররা দিশেহারা হয়ে পড়েন। অনেক পর্যটক তাদের বুকিং বাতিল করে ফিরে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করতে থাকেন। শ্রীনগর বিমানবন্দরের রাস্তায় যানজট তৈরি হয় এবং কাশ্মির থেকে উড়ানের ভাড়া ৩০০ শতাংশের বেশি বেড়ে যায়।

সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টালের নির্বাহী পরিচালক অজয় সাহনি, যিনি দক্ষিণ এশিয়ার সশস্ত্র হামলাগুলোর উপর নজর রাখেন বলেন, ‘কাশ্মিরে কোনো স্বাভাবিক অবস্থা নেই এবং ‘স্বাভাবিকতার’ এই বয়ানই সরকারের কাশ্মির নীতির সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক দিক।’

সাহনি বলেন, ‘প্রথমত, কাশ্মির থেকে সশস্ত্র বিদ্রোহ সম্পূর্ণ নির্মূল করা অসম্ভব, অন্তত রাজনৈতিক সমাধান না আসা পর্যন্ত। দ্বিতীয়ত, ‘স্বাভাবিকতার বয়ান’ এমন একটি ভ্রান্ত পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো আরো হামলা চালাতে উৎসাহিত হয়। কারণ, তারা জানে যে একটি ছোট হামলাও ঘটলে সেটি স্বাভাবিকতাকে বিনষ্ট করে।’

তিনি আরো বলেন, মাঝেমধ্যে হামলা সত্ত্বেও বিদ্রোহীরা এতদিন পর্যটন শিল্পকে মূলত লক্ষ্যবস্তু করেনি। এর ফলে নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে আত্মতুষ্টিরও জন্ম হয়েছে সম্ভবত। আর এটি টিআরএফ-এর কৌশলে হঠাৎ করে তীব্রতা বৃদ্ধির সুযোগ করে দিয়েছে।’

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নিহত ও আহতদের ঘোড়া ও সেনাবাহিনীর যানবাহনে সরিয়ে নেয়া হচ্ছিল। সেই সময় পুলিশ পেহেলগাম শহরটি সিল করে দেয়। ব্যবসায়ী সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলো শোক পালন ও বন্ধের ডাক দেয়। ফলে শ্রীনগরসহ কাশ্মিরের বিভিন্ন অঞ্চলে কার্যত অচলাবস্থা দেখা দেয়।

রাউল, যিনি পহেলগামে আতিথেয়তা শিল্পে কাজ করেন এবং শুধুমাত্র তার প্রথম নাম প্রকাশ করতে অনুরোধ করেন, তিনি বলেন, এই এলাকায় ফের কঠোর নিরাপত্তা আরোপ হবে এবং সেনাবাহিনীর উপস্থিতি আরো বাড়বে। সবাই -আমার ক্লায়েন্টরাও- শুধু কাশ্মির থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে।’

সূত্র : আল জাজিরা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top