কাশ্মিরে হামলা

কাশ্মিরে হামলা : সাজানো নাটক নাকি উগ্রবাদী হামলা

আবু তাসনিম

আবারো কাশ্মিরে হামলা হলো। অন্তত ২৬ জন মানুষ নিহত হলো। শিরোনাম হলো, হিন্দুদের উপর বর্বর ‘জঙ্গি’ হা ম লা। আন্তর্জাতিক সকল মিডিয়া ভারত সরকারের প্রচারিত সংবাদকে ছড়িয়ে দিলো। কিন্তু নিজেরা ঘটনাস্থলে যাওয়ার ‘সুযোগ’ পেলো না।

তবে প্রতিবারের মতো এবারো কাশ্মিরে হামলাকে ঘিরে যে প্রশ্নগুলো সামনে আসছে, তা যতটা না সন্ত্রাসবাদ নিয়ে, তার চেয়ে বেশি প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও কৌশলগত উদ্দেশ্য নিয়ে। এই হামলার প্রেক্ষাপট ও রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া দেখে অনেকেই ঘটনাটিকে ‘নাটক’ বলেও অভিহিত করছেন। প্রশ্ন রাখছেন নানাভাবে। আমাদের পরিসরে যেসব প্রশ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে, তার আলোকেই বিচার করা যাক।

সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার: কী লুকোনো হচ্ছে?

কাশ্মিরে হামলা হলো। যেকোনো বড় হামলার পরেই স্বাভাবিকভাবে মিডিয়া ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। তবে এবার অভিযোগ উঠেছে—সাংবাদিকদের ঘটনাস্থলে ঢুকতে বাধা দেয়া হচ্ছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এরকম তথ্য গোপন রাখার প্রবণতা কি উদ্বেগজনক নয়? যদি সত্যিই হামলা হয়ে থাকে এবং নিরাপত্তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকে, তবে সংবাদমাধ্যমকে কেন প্রতিরোধ করা হচ্ছে? নাকি কিছু দেখানো বা না দেখানোর কৌশল নিয়েই চলছে প্রশাসনিক তৎপরতা?

সন্দেহভাজন নির্ধারণে ‘প্যান্ট খুলে’ পরীক্ষা:

ঘটনার বিবরণ অনুযায়ী, হামলাকারীরা নাকি হিন্দুদের বেছে বেছে হত্যা করেছে এবং হিন্দু কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাদের ‘প্যান্ট খুলে’ দেখা হয়েছে। প্রশ্ন হলো—জঙ্গিদের হাতে এই যাচাই করার ‘সুযোগ’ কীভাবে এলো? এমন কার্যক্রম চালাতে হলে তাদের হাতে থাকতে হয় পর্যাপ্ত সময়, নিয়ন্ত্রণ, এবং নির্ভার উপস্থিতি—যা সাধারণত নিরাপত্তা বাহিনীর নজরদারির মধ্যে সম্ভব নয়। তাহলে তারা এই সুযোগ পেল কোথা থেকে?

কাশ্মিরে হামলায় অভিযুক্ত পাকিস্তান?

হামলার পরই ভারত সরকার থেকে কূটনৈতিক বার্তা আসে—‘এবার কড়া জবাব দেয়া হবে’। প্রশ্ন উঠছে—ঘটনার গভীরে যাওয়া ও নিরপেক্ষ তদন্তের আগেই কিভাবে পাকিস্তানকে দায়ী করে এমন বার্তা দেয়া হলো? যদি সত্যিই পাকিস্তান এর পেছনে থাকে, তবে ‘জবাব’ দিতে প্রস্তুত থাকার যৌক্তিকতা থাকে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কূটনীতি কি এতোটা প্রতিক্রিয়াশীল হওয়া উচিত?

স্ক্যাচে দাঁড়িওয়ালা মুসলমান: উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চিত্রায়ন?

সরকারের পক্ষ থেকে হামলাকারীদের ‘স্ক্যাচ’ প্রকাশ করা হয়েছে—সবাই ‘দাঁড়িওয়ালা মুসলমান’। কিন্তু ভিডিও বা অন্য প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। আবার সাংবাদিকদেরও বাধা দেওয়া হচ্ছে। তাহলে কি এই স্ক্যাচের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মনে নির্দিষ্ট এক সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা তৈরি করাই উদ্দেশ্য? নাকি এটা একটি ছাঁচে ফেলা ‘চেনা গল্প’?

হামলার একদিন পর সংঘর্ষ: পরিকল্পিত থিয়েটার?

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, হামলাকারীদের সাথে ‘তুমুল সংঘর্ষ’ চলছে। প্রশ্ন হলো, ঘটনার দু’দিন পর্যন্ত তারা কি আশপাশেই ছিল? যদি তাই হয়, তবে এতদিন তারা ধরা পড়ল না কেন? আর এখন হঠাৎ সংঘর্ষ শুরু—এটা কি বাস্তবিক, নাকি নাটকীয় পরিণতির অংশ?

কাশ্মিরে হামলা কি ওয়াকফ আন্দোলন থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা?

অনেকে মনে করছেন, এই হামলার প্রচার ও রাষ্ট্রীয় ভাষ্য মূলত সাম্প্রতিক ওয়াকফ সম্পত্তি রক্ষা ও মুসলিম অধিকার সংক্রান্ত আন্দোলনগুলোকে আড়াল করার কৌশল হতে পারে। ভারতে অতীতে বহুবার দেখা গেছে, একটি হঠাৎ সৃষ্ট বা প্রচারিত বড় ঘটনা অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে চাপা দিয়ে দিয়েছে। ওয়াকফ কেন্দ্রিক আন্দোলন, যা মুসলিমদের ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকারের প্রশ্নে উঠে এসেছে, সেটি এখন জাতীয় আলোচনায় এসেছে ঠিক তখনই এই হামলার ঘটনা সামনে এলো—যা সন্দেহ জাগানিয়া।

নাকি নির্বাচনিক ক্যালকুলেশন?

আরেকটি দিক হল, আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করে মেরুকরণ ঘটানো—এটা বহু পুরোনো কৌশল। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, এই ধরণের হামলা এবং তার চারপাশে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রীয় বয়ান আসলে একটি রাজনৈতিক প্রজেক্ট, যার উদ্দেশ্য নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভোটকে ঐক্যবদ্ধ করা। অতীতে গুজরাট বা দিল্লি সহ বহু ক্ষেত্রে এই ধরনের ‘দুর্ভাগ্যজনক সময়সূচিত’ ঘটনার নজির পাওয়া গেছে।

নাটক, নাকি বাস্তবতা—প্রশ্ন থাকা উচিত, উত্তর খোঁজা আরও জরুরি

যে যাই বলুক, কাশ্মিরে হামলার ঘটনা বিশ্লেষণ করলে একে নিছক ‘সন্ত্রাসী হামলা’ হিসেবে দেখলে সত্য গোপন থাকে। কাশ্মিরে হামলার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ, এবং আন্তর্জাতিক বার্তার মিশ্র খেলা থাকতে পারে—যা শুধুমাত্র ‘জঙ্গি’ শব্দে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাই আমাদের দায়িত্ব—প্রশ্ন তোলা, ভাবা এবং রাষ্ট্রীয় বয়ানের বাইরে গিয়ে সত্য অনুসন্ধান করা। কারণ প্রতিটি ‘নাটক’ শেষ পর্যন্ত যদি সত্য হয়ে ওঠে, তাহলে ইতিহাসে আমরা সবাই দর্শক মাত্র।

লেখক : সাংবাদিক

কাশ্মীরে পর্যটকদের উপর সন্ত্রাসী হামলা, নিহত ২৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top