সম্প্রতি ভারত শাসিত কাশ্মিরে হামলা হয়েছে। স্থানীয় মনোরম পর্যটন কেন্দ্র পহেলগামে সন্দেহভাজন বিদ্রোহীদের হামলায় কমপক্ষে ২৬ জন নিহত হয়েছেন, যা ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা আরও বাড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে।
কাশ্মিরের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা অনন্তনাগে এই হামলার ঘটনায় গোটা ভারতে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাটি ঘটে পর্যটন মৌসুমের শীর্ষ সময়ে, যখন লক্ষ লক্ষ পর্যটক কাশ্মিরে ছুটি কাটাতে আসেন—একটি এলাকা, যা তিন দশক ধরে সশস্ত্র বিদ্রোহের কবলে রয়েছে।
কাশ্মিরে হামলার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী আহতদের উদ্ধার এবং হামলাকারীদের খোঁজে অভিযান শুরু করে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাশ্মিরে যান। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সৌদি আরব সফর সংক্ষিপ্ত করে নয়াদিল্লিতে ফিরে আসেন এবং বুধবার সকালে ভারতের প্রতিক্রিয়া নির্ধারণে বৈঠক করেন।
কাশ্মীর পর্যটক হামলার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক চরমে
সোমবার ভারত পৌঁছানোর পর প্রধানমন্ত্রীর বৃহস্পতিবার দেশ ত্যাগ করার কথা থাকলেও তার আগেই এই হামলার ঘটনা ঘটে।
নিচে কাশ্মিরে হামলা সম্পর্কিত বিস্তারিত—ঘটনার বিবরণ, ক্ষতিগ্রস্তরা, হামলাকারীরা, এই হত্যাকাণ্ডের পটভূমি, কাশ্মির ও অঞ্চলের উপর এর প্রভাব এবং ভারতের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হলো।
কাশ্মিরে হামলা : কী ঘটেছে?
‘পহেলগাম’—যার অর্থ কাশ্মিরি ভাষায় ‘মেষপালকদের উপত্যকা’—এই অঞ্চলটি কাশ্মিরের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র, যা শ্রীনগর শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরে অবস্থিত।
মঙ্গলবার প্রত্যক্ষদর্শীরা আল জাজিরাকে জানান, ওই এলাকা ছিল পর্যটকে ভরা। দুপুর ২:৪৫ মিনিটে ছদ্মবেশে থাকা একদল সশস্ত্র ব্যক্তি পাশের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে, জানালেন এক কর্মকর্তা, যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অবস্থায় এমন তথ্য দিচ্ছিলেন যা এখনো নিরাপত্তা বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি।
হামলাকারীরা “বাইসারান তৃণভূমিতে নির্বিচারে গুলি চালায়”—এটি একটি মনোরম উঁচু এলাকা, যেখানে কেবল পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়ে পৌঁছানো যায়, বলেন ওই কর্মকর্তা। হঠাৎ গুলির শব্দে অনেক পর্যটক হতভম্ব হয়ে পড়েন।
ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রের নাগপুর থেকে আসা পর্যটক সিমরান চন্দানি বলেন, তিনি নিশ্চিত ছিলেন না তিনি এই হামলা থেকে বাঁচতে পারবেন।
“আমরা চা ও ম্যাগি [একটি জনপ্রিয় প্যাকেটজাত নুডলস] খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম,” বলেন তিনি। পহেলগামকে তিনি “মিনি-সুইজারল্যান্ড” বলে বর্ণনা করেন।
কাশ্মিরে হামলা : সাজানো নাটক নাকি উগ্রবাদী হামলা
এরপর মুহূর্তেই দৃশ্যপট পাল্টে যায়। “আমি একদল লোককে নামতে দেখলাম। আমরা ভেবেছিলাম বেলুন ফেটেছে। মানুষ একে অপরকে ধাক্কা দিচ্ছিল। তখন কেউ একজন আমাদের জানাল যে হামলা হয়েছে,” স্মরণ করেন তিনি। আরও জানান, বেশিরভাগ পুরুষদের লক্ষ্য করেই গুলি চালানো হয়।
তিনি পালাতে চাওয়া অন্যদের সঙ্গে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। “আমি ঈশ্বরের নাম নিয়ে ছুটছিলাম,” বলেন চন্দানি।
কাশ্মিরে হামলায় কতজন নিহত হয়েছে
কাশ্মিরে হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত হয়েছেন এবং আরও এক ডজনের বেশি আহত হয়েছেন।
নিহতদের প্রায় সবাই বেসামরিক নাগরিক। তাদের মধ্যে ছিলেন ভারতীয় নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তা, যিনি তার মধুচন্দ্রিমা কাটাতে এসেছিলেন।
অন্ধ্র প্রদেশের পান্ডুরঙ্গাপুরমের ৬৮ বছর বয়সী একজন প্রাক্তন ব্যাংকার, যিনি স্ত্রীর সঙ্গে অঞ্চলটি পরিদর্শন করছিলেন, তিনিও নিহত হন। এছাড়াও কর্ণাটকের একজন রিয়েলটর, ওড়িশার একজন হিসাবরক্ষক, উত্তর প্রদেশের একজন সিমেন্ট ডিলার এবং উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে ফেরা কেরালার এক ব্যক্তি নিহতদের মধ্যে ছিলেন।
এছাড়াও, নিহতদের মধ্যে নেপালের একজন বিদেশি নাগরিকও ছিলেন।
কাশ্মীরে পর্যটকদের উপর সন্ত্রাসী হামলা, নিহত ২৬
হামলার দায় কে স্বীকার করেছে?
পাকিস্তান-ভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বার একটি শাখা, ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) নামে পরিচিত একটি গোষ্ঠী, হামলার দায় স্বীকার করে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, কাশ্মিরে হাজার হাজার ভারতীয় নাগরিককে আবাসিক পারমিট দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় এই হামলা চালানো হয়েছে, যা তাদের কাশ্মিরে বসবাস ও কাজ করার অনুমতি দেয়। তবে, আল জাজিরা স্বাধীনভাবে এই বিবৃতির সত্যতা যাচাই করতে পারেনি।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে ভারত সরকার কাশ্মিরের আধা-স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদা বাতিল করে কেন্দ্রীয় শাসনের আওতায় আনে এবং অঞ্চলটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে। এর ফলে রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বেড়ে যায় এবং অ-কাশ্মিরিদের জন্য বসবাসের অনুমতি পাওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়, যা আগে নিষিদ্ধ ছিল।
ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আল জাজিরাকে জানান, তারা সন্দেহ করছেন এই হত্যাকাণ্ডে চারজন হামলাকারী অংশ নিয়েছে—যাদের মধ্যে দুজন পাকিস্তানি এবং দুজন ভারত-শাসিত কাশ্মিরের বাসিন্দা।
অতীতে কি পর্যটকদের উপর হামলা হয়েছে?
কাশ্মিরের অস্থির পরিবেশের মধ্যেও পর্যটকদের উপর সরাসরি হামলার ঘটনা খুবই বিরল।
১৯৯৫ সালে, পহেলগামে আল-ফারান নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী ছয়জন বিদেশি পর্যটককে অপহরণ করে। তাদের মধ্যে একজন নিহত হন, একজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হন, আর বাকি চারজনের কোনো খোঁজ আর মেলেনি।
২০০০ সালে, পহেলগামের নুনওয়ানে ২১ জন হিন্দু তীর্থযাত্রীসহ মোট ৩২ জনকে হত্যা করা হয়।
এর ঠিক এক বছর পর, একই এলাকার শেষনাগ হ্রদের কাছে ১১ জন তীর্থযাত্রী এবং দুইজন স্থানীয়সহ ১৩ জন নিহত হন। ২০১৭ সালে, অনন্তনাগ জেলায় এক গুলিবর্ষণের ঘটনায় আটজন তীর্থযাত্রী প্রাণ হারান। গত বছরের জুন মাসে, জম্মুর কাঠুয়ার দক্ষিণাঞ্চলে তীর্থযাত্রীবাহী একটি বাস চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে খাদে পড়ে যায়। এর আগে বাসটি হামলার শিকার হয়েছিল, ফলে আটজন হিন্দু তীর্থযাত্রী নিহত হন।
তবে মঙ্গলবারের হামলাটি সম্ভবত ২০০০ সালের নুনওয়ানের ঘটনার পর পর্যটকদের উপর সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা।
সামগ্রিকভাবে, ২০০১ সালের অক্টোবরে জম্মু ও কাশ্মির রাজ্য আইনসভার বাইরে বোমা বিস্ফোরণে ৩৫ জন নিহত হওয়ার পর এটি সবচেয়ে বড় হামলা, যাতে এত প্রাণহানি ঘটেছে।
হামলার ধরন ও মাত্রা বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের পাশাপাশি স্থানীয় রাজনীতিকদেরও হতবাক করে দিয়েছে।
“আমরা পহেলগামে গিয়েছিলাম, তৃণভূমিতে একটি চেয়ারে বসেছিলাম, হঠাৎ করেই তিনটি গুলির শব্দ শুনি যা চারদিকে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে,” বলেন পশ্চিম ভারতের গুজরাট রাজ্যের ৬৫ বছর বয়সী পর্যটক বিনু বাই, যিনি অনন্তনাগের জেলা হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। “সবাই ছুটতে শুরু করে। সেই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই গুলিটি আমার বাহুতে লাগে।”
“আমরা ভাবছিলাম, কাশ্মির এখন শান্তিপূর্ণ। এমন কিছু ঘটবে, তা কল্পনাও করিনি।”
স্থানীয় বিরোধীদল-ঘনিষ্ঠ তরুণ রাজনীতিক ইলতিজা মুফতি বলেন, পহেলগাম এলাকায় সাধারণত ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়মিত টহল দেখা যায়। “বৈসরণের মতো জায়গায় এমন হামলা হওয়া,” তিনি বলেন, “অত্যন্ত বেদনাদায়ক।”
“আমাদের সমাজে এরকম বর্বরোচিত হামলার কোনো স্থান নেই।”
ভারত সরকার কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে?
বুধবার, ভারতের শীর্ষ নেতারা দেশের প্রতিক্রিয়া কৌশল নির্ধারণে একটি বৈঠক করেন।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর সৌদি আরবে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে নৈশভোজে অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও, তিনি সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরে আসেন।
“আমি জম্মু ও কাশ্মিরের পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। যারা প্রিয়জন হারিয়েছেন, তাদের প্রতি আমার গভীর সমবেদনা রইল। আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। ক্ষতিগ্রস্তদের সবরকম সহায়তা দেওয়া হচ্ছে,” মোদী এক টুইটে বলেন। “এই নৃশংস ঘটনার পেছনে যারা আছে, তারা কোনোভাবেই রেহাই পাবে না—তাদের বিচার হবেই!”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ শ্রীনগরে গিয়ে শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
বিজেপির ‘এক দেশ এক ধর্ম’ বাস্তবায়নে চরম সঙ্কটে মুসলিমরা
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধী সরকারকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ২০১৯ সালে কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর কেন্দ্র সরকার যে ‘স্বাভাবিকতা’র দাবি করে আসছে, তা আদতে ফাঁপা প্রচারণা।
“সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে গোটা দেশ একতাবদ্ধ,” বলেন গান্ধী। “কাশ্মিরে স্বাভাবিকতা ফিরেছে—এমন দাবির পরিবর্তে সরকারের উচিত দায়িত্ব স্বীকার করে ভবিষ্যতে এ ধরনের নৃশংস হামলা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।”
ভারত কি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে পারে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই হামলার পর ভারতের প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
“এটি একপ্রকার যুদ্ধ ঘোষণা করার মতো। আমরা বিষয়টিকে তেমনভাবেই দেখছি। এই ঘটনার কয়েকদিন আগেই পাকিস্তানের সেনাপ্রধান একটি বক্তব্য দিয়েছিলেন,” বলেন নয়াদিল্লিভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর ল্যান্ড ওয়ারফেয়ার স্টাডিজ’-এর পরিচালক তারা কার্থা। তিনি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ সচিবালয়ের সাবেক কর্মকর্তা এবং পাকিস্তানি সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের সেই বক্তব্যের কথা উল্লেখ করছিলেন, যেখানে তিনি ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের ভিত্তি ‘দ্বি-জাতি তত্ত্ব’-এর প্রতি তার সমর্থন পুনরায় প্রকাশ করেন এবং “হিন্দুদের থেকে পার্থক্য” বজায় রাখার কথা বলেন।
কার্থা বলেন, পহেলগামের এই হামলা মুনিরের ১৬ এপ্রিলের ‘উস্কানিমূলক’ বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে গভীর তাৎপর্য বহন করে। “যদি পাকিস্তান এই হামলার তীব্র নিন্দা না জানায় এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে বড় ধরনের সংকট এড়ানো কঠিন হবে।”
ভারতের নন্দনগরে মুসলিম নিধন, শহরের সর্বশেষ মুসলিম দম্পতির নিদারুণ লড়াই
বুধবার ভোরে পাকিস্তান তাদের প্রতিক্রিয়া জানায়।
“ভারতীয় অবৈধ দখলকৃত জম্মু ও কাশ্মিরের অনন্তনাগ জেলায় হামলায় পর্যটকদের মৃত্যুতে আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। নিহতদের পরিবারের প্রতি আমরা সমবেদনা জানাচ্ছি এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি,” এক বিবৃতিতে জানায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
উল্লেখ্য, ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই সম্পূর্ণ কাশ্মির অঞ্চল দাবি করে এবং বর্তমানে উভয়েই এর একটি করে অংশের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে।
যদিও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি উত্তেজনা প্রশমনে খুব একটা সহায়ক হবে না বলেই ধারণা, বিশেষ করে যখন ভারতের অভ্যন্তরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি বাড়ছে, তবুও কিছু বিশ্লেষক আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া এড়াতে সতর্ক করছেন।
ভারতে ওয়াকফ আইন পাসের পরই মধ্যপ্রদেশে ভাঙা হলো মাদ্রাসা
নয়াদিল্লিভিত্তিক প্রবীণ রাজনৈতিক ভাষ্যকার সাবা নকভি বলেন, “ভারতের আপেক্ষিক স্থিতিশীলতা—এই অস্থির প্রতিবেশী অঞ্চলের তুলনায়—তার প্রতিক্রিয়ার পথ নির্ধারণে বিবেচ্য হওয়া উচিত।”
তিনি বলেন, “অনেকেই বিশ্বাস করেন বিজেপি সরকার প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানে বোমা ফেলবে, কিন্তু বিষয়টা এতটা সরল নয়।”
উত্তর প্রদেশের লক্ষাধিক ওয়াকফ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ রাজ্য সরকারের
কাশ্মিরের জন্য এই হামলার তাৎপর্য কী?
কাশ্মিরি রাজনীতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শেষ পর্যন্ত কাশ্মিরিদেরকেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে।
“এটি নিঃসন্দেহে একটি সন্ত্রাসী হামলা,” বলেন বিরোধী দল পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) কাশ্মিরি আইনপ্রণেতা ওয়াহিদ উর রহমান পারা। আল জাজিরাকে তিনি বলেন, “এই হামলার পেছনে যারা আছে, তারা শুধু নিরীহ মানুষকে হত্যা করেনি, বরং কাশ্মিরিদের অর্থনীতি এবং সদ্য ফিরে আসা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ধারণাকেই ধ্বংস করতে চায়।”
কাশ্মিরের অর্থনীতিতে পর্যটন একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত, যা অঞ্চলের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৭ শতাংশ জুড়ে রয়েছে। এই অঞ্চলে পর্যটকদের আগমন শুধু অর্থনৈতিক গতিশীলতার ইঙ্গিত নয়, বরং মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের দাবিমতো কাশ্মিরে শান্তি ও উন্নয়নের প্রমাণ বলেও প্রচার করা হয়।
তবে বাস্তবে পরিস্থিতি কখনোই পুরোপুরি স্বাভাবিক ছিল না। ২০১৯ সালে কাশ্মিরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিলের পর থেকে হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ নাগরিককে কঠোর আইনের আওতায় বিনা বিচারে আটক রাখা হয়েছে।
ভারতে প্রকাশ্যে মুসলিম নারীর হিজাব খুলে নিলো উগ্রবাদীরা
গত বছরের অক্টোবরে কাশ্মিরে এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। স্বায়ত্তশাসন পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচারণা চালিয়ে জনপ্রিয় নেতা ওমর আবদুল্লাহ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেন। তবে নতুন আইনের অধীনে তার ক্ষমতা খুব সীমিত—মূল কর্তৃত্ব এখন কেন্দ্র-নিযুক্ত লেফটেন্যান্ট গভর্নরের হাতে।
এই বাস্তবতায় পহেলগাম হামলা কাশ্মিরি হোটেল মালিক ও ট্যুর অপারেটরদের জন্য নতুন করে কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে তারা বাধ্য হচ্ছেন।
পহেলগামের হোটেল ব্যবসায়ী ও স্থানীয় হোটেল মালিকদের সংগঠনের প্রাক্তন সভাপতি আব্দুল ওয়াহিদ মালিক বলেন, “এই বর্বরতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এখন আমাদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হলো, এই হামলার ফলে যে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে তা মোকাবিলা করা। পর্যটন আপাতত আমাদের অগ্রাধিকার নয়।”
তিনি জানান, হামলার পর রামবান অঞ্চলে ভূমিধসে সড়কপথ ব্যাহত হয়, বিমান ভাড়া বেড়ে যায়, এবং আতঙ্কিত পর্যটকদের উপত্যকা ত্যাগ করাও কঠিন হয়ে পড়ে। একটি পরিবার আটকে পড়ার খবর পেয়ে তিনি নিজেই তাদের জন্য নিজের হোটেলে চারটি কক্ষের ব্যবস্থা করেন। “তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এখন আমাদের দায়িত্ব,” বলেন মালিক। “এই হামলা আমাদের ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে।”
এই ঘটনার প্রতিবাদে বুধবার কাশ্মিরের ব্যবসা ও পর্যটন প্রতিষ্ঠানগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্ধ রাখে। বহু সাধারণ নাগরিকও হামলার নৃশংসতায় হতচকিত।
“কাশ্মির চিরকাল উষ্ণ আতিথেয়তা ও সৌহার্দ্যের জন্য পরিচিত,” বলেন শ্রীনগরের ৩১ বছর বয়সী বাসিন্দা নাদিয়া ফারুক। “এই রক্তক্ষয়ী হামলায় আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আমরা শান্তি চাই, রক্তপাতের অবসান চাই।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
বিশ্বনেতারাও হামলার নিন্দা জানিয়ে ভারতের জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক্স-এ দেওয়া এক বার্তায় লেখেন, “কাশ্মিরের এই সন্ত্রাসী হামলার খবর গভীরভাবে উদ্বেগজনক। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে। আমরা নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করি এবং আহতদের প্রতি সহানুভূতি জানাই। প্রধানমন্ত্রী মোদী ও ভারতের জনগণের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।”
ভারত সফররত মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ও তার স্ত্রী উষা হামলায় শোক প্রকাশ করেন। “এই দেশের সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করেছে। এমন দুঃসময়ে আমাদের প্রার্থনা ও সহানুভূতি হামলার শিকারদের সঙ্গে রয়েছে।”
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কায়ার স্টারমার একে “অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক হামলা” আখ্যা দিয়ে বলেন, “আমার হৃদয় ক্ষতিগ্রস্তদের ও ভারতের জনগণের পাশে রয়েছে।”
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই হামলাকে “নৃশংস অপরাধ” হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, “এ ধরনের বর্বরতাকে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করা যায় না।”
সংযুক্ত আরব আমিরাত এক বিবৃতিতে হামলাটিকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যা দিয়ে সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের সর্বপ্রকার প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেয়।
সূত্র : আল জাজিরা