শায়খ ইবনুল কালাম
সময়টি ছিল ২০০৯ সাল। বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে ঘটে যায় বড় তিনটি ঘটনা। প্রতিটি ঘটনাই বাঙালি মুসলিম মানসে গভীর প্রভাব ফেলে। কপালে আঁকে চিন্তার ভাঁজ। মুসলিমরা নড়েচড়ে বসে। এ যে তাদের পরিচিত জীবনাচার ও ধর্মবিশ্বাসেরই মূলে কূঠারাঘাত। তারা সচকিত হয়ে পড়ে ভবিষ্যত নিয়ে। ঘটনা তিনটি হলো এই,
১. জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০৯
তখন ক্ষমতায় আওয়ামী লীগের সরকার। দেশকে নিজেদের মতো ঢেলে সাজাচ্ছে তারা। এরই মধ্যে মনোযোগ দিয়েছে শিক্ষাব্যবস্থায়। ২০০৯ সালের ৬ এপ্রিল গঠন করা হয় শিক্ষা কমিটি। নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ণের দায়িত্ব দেয়া হয় তাদের। এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয় জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরীকে। কো-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান ড. খালেকুজ্জামান। তাদের সঙ্গে দেয়া হয় আরো ১৮ শিক্ষাবিদকে। মোট ২০ সদস্যের দল নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ণের কাজ শুরু করেন। এক্ষেত্রে তারা সহযোগিতা নেন দু’টি শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের। একটি ১৯৭২ সালের ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন প্রণীত রিপোর্ট। অপরটি ১৯৯৭ সালের ড. শামসুল হক শিক্ষা কমিশন প্রণীত রিপোর্ট। এই দুটি রিপোর্টকে সামনে রেখেই তারা মেহনত শুরু করেন। দীর্ঘ ১৭ মাসের মেহনতে তৈরি করেন নতুন শিক্ষা নীতি। ২০১০ সালের ২ সেপ্টেম্বর পেশ করেন সরকারের কাছে। এরপর এই শিক্ষানীতি ১৭ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয়। সরকার নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে মোট ২৪টি সাব-কমিটি গঠন করে। পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদত্ত প্রাক-কথন ও শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ প্রদত্ত মুখবন্ধ যুক্ত করে মোট ২৮টি অধ্যায় এবং দু’টি সংযোজনীসহ ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ সাধারণের সামনে পেশ করে।
কবির চৌধুরীর এই শিক্ষা কমিশন দাবি করে যে নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ণে ব্যাপকভাবে মতামত নেয়া হয়েছে। সেজন্য তারা বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট ৫৬টি সংস্থা ও সংগঠনের সাথে কথা বলেছে। পরে ১৭ ডিসেম্বর তা সংসদে পাস হওয়ার পর সাধারণ মানুষের মতামত জানতে চাওয়া হয়। সেজন্য খসড়াটি তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে এবং জানায়, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ বিষয়ে যেকেউ মতামত দিতে পারবে। পরে তারা প্রদত্ত মতামতগুলো পর্যালোচনা করে দেখবেন।
নতুন শিক্ষানীতি ওয়েবসাইটে প্রকাশের পর থেকেই শুরু হয় তুমুল বিরোধিতা। সচেতন নাগরিক সমাজ বিভিন্ন বিষয়ে আপত্তি তোলেন। সবচেয়ে জোরালো আপত্তি ছিল শিক্ষানীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে। সচেতন নাগরিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই শিক্ষানীতির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে স্যেকুলারতন্ত্র ও ইসলামী মূল্যবোধবিরোধী চেতনা। তাই এটি কোনোভাবেই মুসলিমপ্রধান একটি দেশের শিক্ষানীতি হতে পারে না।
তারা আরো বলেন, এই শিক্ষানীতির ভিত্তি হলো ১৯৭৪ সালে প্রণীত ড. কুদরত-ই-খুদা এবং ১৯৯৭ সালে প্রণীত ড. শামসুল হকের শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট। আর এই দুই রিপোর্টকেই প্রত্যাখ্যান করেছিল দেশের আপমর জনসাধারণ। কারণ, উভয়টিরই লক্ষ্য ছিল সমাজতান্ত্রিক ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী এবং সমাজতান্ত্রিক দর্শনের নীতিমালা সম্পন্ন চরিত্রবান নাগরিক গড়ে তোলা। আর মুসলিমপ্রধান কোনো দেশের শিক্ষানীতির লক্ষ্য এটা হতে পারে না। তাই তাই দেশ ও জাতির স্বার্থে এ-শিক্ষানীতি কোনো অবস্থাতেই বাস্তবায়িত হতে পারে না।
কমিশনের কো-চেয়ারম্যান ড. খালেকুজ্জামান তাদের এই আপত্তির কথা স্বীকার করেছেন। তিনি এক প্রবন্ধে বলেন, ‘শিক্ষানীতির সমালোচনা করে কিছু পেশাজীবী সংগঠন স্ববিরোধী বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তারা বলেন, ইতোপূর্বেকার কুদরাত-ই-খুদা ও শামসুল হক শিক্ষা কমিশনে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা গুরুত্ব না পাওয়ায় বরাবরই এ-জাতি সে বিষয়ে আপত্তি তুলেছে। বর্তমানে প্রণীত শিক্ষানীতি ২০১০-কেও খুদা এবং হক কমিশনেরই প্রতিরূপ (replica) বলে মনে হয়েছে। এজন্যই এ শিক্ষানীতিতে অনেক ভাল প্রস্তাব থাকার পরও জাতি তা মেনে নিতে প্রস্তুত বলে মনে হয় না। তারা আরো বলেন, এ শিক্ষানীতি বাস্তাবায়িত হলে একজন সাধারণ ধারার শিক্ষার্থী শিক্ষা জীবনের সূচনা হতে প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করা ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। তাই দেশ ও জাতির স্বার্থে এ-শিক্ষানীতি কোন অবস্থাতেই বাস্তবায়িত হতে পারে না। (জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০, পর্যালোচনা মন্তব্য ও পরামর্শ, বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক পরিষদ, ঢাকা, ৬ ডিসেম্বর ২০১০, পৃ.৪, ১৬)
এরপর এই আপত্তির জবাবে তিনি ওই বলেন, প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ একমাত্র শিক্ষানীতি যেখানে শিক্ষাধারা নির্বিশেষে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টি বাধ্যতামূলক। সুতরাং উল্লিখিত মন্তব্য যে ভিত্তিহীন, মনগড়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও উস্কানিমূলক তাতে কোন সন্দেহ নেই।’
তবে ড. খালেকুজ্জামানের এই দাবি সর্বাংশে সঠিক নয়। কারণ, কাগজে-কলমে যদিও তারা ধর্মশিক্ষা নিশ্চিত করেছে; কিন্তু সিলেবাসটা এমনভাবে সাজিয়েছে যে তা থেকে ধর্মের মৌলিক শিক্ষাটুকুও অর্জন করা যায় না। এছাড়া ধর্মশিক্ষার জন্য এমন শিক্ষককে বাছাই করা হয়, ধর্ম সম্পর্কে যার গভীর জ্ঞান নেই। কোনো কোনো স্কুলের ক্ষেত্রে এও শোনা গেছে যে ইসলাম ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার ক্লাস নেন হিন্দু শিক্ষক। এরচেয়ে বড় কথা হলো, ধর্ম শিক্ষাকে তারা ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রেখেছে। সেজন্য যদিও ধর্মশিক্ষা সিলেবাসে রয়েছে, কিন্তু শিক্ষার্থীরা এই বইয়ের প্রতি ভ্রুক্ষেপও করে না। কখনো এমন হয় যে মাস চলে গেলেও ছাত্ররা ধর্মশিক্ষার বই খুলে বসে না। সেজন্য ড. খালেকুজ্জামানের এই দাবি শুভঙ্করের ফাঁকির মতো; একটি মুসলিম প্রধান দেশের নাগরিকদের প্রত্যাশা যাতে বিন্দুমাত্রও প্রতিফলিত হয় না।
আবারো ফিরি শিক্ষানীতি প্রসঙ্গে। এই শিক্ষানীতির কয়েকটি মৌলিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে, ইসলামের সাথে যা সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। তা হলো এই যে ১. সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা। ২. জনগণের মধ্যে ধর্ম নিরপেক্ষতাবোধ জাগ্রতকরণ। ৩. অসাম্প্রদায়িক শিক্ষার্থী গঠন। ৪. সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে সম-মৌলিক চিন্তা চেতনা সৃষ্টিকরণ। নিম্নে এই বিষয়ক ধারাগুলো আমরা তুলে ধরছি। পাশাপাশি মন্তব্য বলে প্রয়োজনীয় নোট তুলে ধরব।
এক. জাতীয় শিক্ষানীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, ‘শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়ন ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলা।’ পৃষ্টা-১
মন্তব্য : এখানে শিক্ষানীতির একটি মৌলিক উদ্দেশ্য বলা হয়েছে যে ‘নিজের এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল’ হিসেবে গড়ে তোলা। এটি সম্পূর্ণরূপে কুরআনি শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
إن الدين عند الله الإسلام
অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার কাছে একমাত্র মনোনীত ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৯
অপর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের তালাশ করবে, তার এই প্রচেষ্টা গৃহীত হবে না। বরং সে হবে আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৯
মোটকথা ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, নিজ ধর্ম বা আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা, বিশ্বাস, ভালবাসা, মমত্ববোধ রাখা। এছাড়া অন্য কোনো ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে না। তবে হাঁ, অপর ধর্মের প্রতি তার সহিষ্ণুতা থাকবে। সুতরাং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলা ইসলামী মূল্যবোধের সাথে যায় না।
এমনিভাবে অসাম্প্রদায়িক শব্দটিও আপত্তিকর। কারণ, প্রত্যেক ধর্মের লোকজনই তাদের ধর্মকে আশ্রয় করে সম্প্রদায়ভুক্ত হয়। সুতরাং প্রতিটি ধর্মই সাম্প্রদায়িকতা শিক্ষা দেয়। সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত হতে চায় স্যেকুলারিজম। তবে কি শিক্ষার্থীরা নিজ ধর্মকে বিসর্জন দিয়ে স্যেকুলার হয়ে যাবে? ধর্ম আশ্রিত নানা সম্প্রদায় বৈচিত্রের এই বাংলাদেশে এই শিক্ষা দেশের অধিকাংশ মানুষেরই প্রত্যাশার প্রতিনিধিত্ব করে না।
এখানে কুসংস্কারমুক্ত শব্দটিও সন্দেহজনক। কারণ, কমিশন সদস্যরা স্যেকুলারিজমে প্রভাবিত। আর স্যেকুলারিজমে ধর্মকেও কুসংস্কারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এখন কুসংস্কারমুক্ত এর অর্থ যদি হয় ধর্মমুক্ত, তবে তো তা তুমুল আপত্তিজনক।
দুই. এর এক বাক্য পরে বলা হয়েছে, ‘এই শিক্ষানীতি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে সেক্যুলার, গণমুখী, সুলভ, সুষম, সর্বজনীন, সুপরিকল্পিত এবং মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি ও রণকৌশল হিসেবে কাজ করবে।”(পৃষ্ঠা-১)
মন্তব্য : এই পয়েন্টটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা মানেই সেখানে ধর্মের বাঁধন থাকবে না। তো একটি মুসলিম প্রধান দেশ এবং ধর্ম আশ্রিত নানা সম্প্রদায়ে গড়ে ওঠা এই বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য ধর্মের বাঁধন থেকে মুক্তি কেন হবে? এটি জাতির প্রত্যাশার প্রতিফলন হতে পারে না।
তিন. শিক্ষার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও নীতিগত তাগিদ উল্লেখ করতে গিয়ে ৩ নম্বর ধারায় সেক্যুলারিজমকে সুনাগরিকের গুণ হিসেবে উপস্থাপন করে বলা হয়েছে, ‘৩. মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে তোলা ও তাদের চিন্তা-চেতনায় দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ এবং তাদের চরিত্রে সুনাগরিকের গুণাবলীর (যেমন ন্যায়বোধ, অসাম্প্রদায়িক-চেতনাবোধ, কর্তব্যবোধ, মানবাধিকার সচেতনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, শৃঙ্খলা, সৎজীবনযাপনের মানসিকতা, সৌহার্দ্য, অধ্যবসায় ইত্যাদি) বিকাশ ঘটানো। পৃষ্ঠা-১
মন্তব্য : এখানে সেক্যুলারিজম ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধকে সুনাগরিকের বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা চরম আপত্তিজনক। এছাড়া মুক্তবুদ্ধির চর্চাও আপত্তিজনক। কারণ, সেক্যুলাররা মুক্তবুদ্ধি বলতে ধর্মের বিরোধিতাকেই বুঝিয়ে থাকে।
চার. ‘শিক্ষার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও নীতিগত তাগিদ’-এর ৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘জাতি, ধর্ম, গোত্র নির্বিশেষে আর্থসামাজিক শ্রেণী-বৈষম্য ও নারীপুরুষ বৈষম্য দূর করা, অসাম্প্রদায়িকতা, বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য ও মানুষে মানুষে সহমর্মিতাবোধ গড়ে তোলা এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলা।’ পৃষ্ঠা-১
মন্তব্য : এখানে ‘নারীপুরুষ বৈষম্য দূর করা’কে শিক্ষার উদ্দেশ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেক্যুলারিজমে নারী-পুরুষ বৈষম্য বলতে বুঝায় সম্পদে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার, নারীরাও পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কঠিন কাজগুলো করবে, পর্দা ছাড়া চলবে, এভাবে পুরুষের মতোই সব ধরনের অধিকার পাবে। নারীপুরুষ বৈষম্য দূরীকরণ বলতে তারা এই জাতীয় কিছু বিষয়কে বুঝিয়ে থাকে। যা স্পষ্ট শরীয়তের সাথে সাংঘর্ষিক।
‘জাতি, ধর্ম, গোত্র নির্বিশেষে আর্থসামাজিক শ্রেণী-বৈষম্য দূর করা’ এই উদ্দেশ্যটিও আপত্তিজনক।
পাঁচ. ‘শিক্ষার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও নীতিগত তাগিদ’-এর ১৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে সম-মৌলিক চিন্তাচেতনা গড়ে তোলা এবং জাতির জন্য সম-নাগরিক ভিত্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে সব ধারার শিক্ষার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যবই বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণ। একই উদ্দেশ্যে মাধ্যমিক স্তরেও একইভাবে কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে পাঠদান।’ পৃষ্ঠা-২
মন্তব্য : সম-মৌলিক চিন্তাবিশ্বাসী হতে বলা হয়েছে। সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে সম মৌলিক চিন্তা-চেতনা গড়ে তোলার নীতি যৌক্তিক ও বাস্তবানুগ নয়। কারণ মানুষের চিন্তা ও চেতনা তার ধর্মীয় বিশ্বাস, কর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এক্ষেত্রে বরং শিক্ষার্থীদের স্ব স্ব ধারার শিক্ষার ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে মৌলিক বিষয়ের সমমানের জ্ঞান অর্জনের ব্যবস্থা করাই যুক্তিযুক্ত। মূলত সম-মৌলিক চিন্তাবিশ্বাসী বলতে কি বুঝানো হচ্ছে? প্রগতিশীল সেক্যুলার, পুঁজিবাদী, সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী চিন্তা? অথবা অসম্প্রদায়িক চিন্তা? কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা? নাকি হিন্দুত্ববাদী চিন্তা? আমরা তো এসব চিন্তায় বিশ্বাসী নই। আমরা নিরেট কুরআন-সুন্নাহর চিন্তায় বিশ্বাসী। কে কীভাবে যুক্তি দিল সেটা আমরা যাচাই করি কুরআন-সুন্নাহর কষ্টিপাথরে। সুতরাং এসব অনৈতিক কথা আমাদের মৌলিক আদর্শ ও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না।
ছয়. প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার কৌশল ১-এ বলা হয়েছে, ‘অন্যান্য গ্রহণযোগ্য উপায়ের সঙ্গে ছবি, রং, নানা ধরনের সহজ আকর্ষণীয় শিক্ষাউপকরণ, মডেল, হাতের কাজের সঙ্গে ছড়া, গল্প, গান ও খেলার মাধ্যমে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হবে।’ পৃষ্ঠা-৩
সাত. প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার কৌশল ৪-এ বলা হয়েছে, ‘মসজিদ, মন্দির, গীর্জা ও প্যাগোডায় ধর্ম মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত সকল ধর্মের শিশুদেরকে ধর্মীয়জ্ঞান, অক্ষরজ্ঞানসহ আধুনিক শিক্ষা ও নৈতিকতা শিক্ষাপ্রদানের কর্মসূচি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার অংশ হিসেবে গণ্য করা হবে।’ পৃষ্ঠা-৩
মন্তব্য : এই শিক্ষার মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষার চূড়ান্ত উপক্ষা ফুটে উঠেছে। এর মধ্য দিয়ে ধর্মশিক্ষাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার কূটকৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া ধর্মমন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার সিলেবাস এতটাই মানহীন যে কোনো দায়িত্বশীল অভিভাবক নিজের সন্তানকে ওই সিলেবাসে পড়াতে রাজি হবে না। তদুপরি বিভিন্ন স্থানে প্রাক-প্রাথমিক মক্তব এতটাই অবহেলিত যে মক্তবের কেবল বোর্ডই লাগানো থাকে। বাস্তবে মক্তব কার্যকরী থাকে না। আর এই খাতের টাকা পয়সা স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাকর্মীদের ভাগ-বটোয়ারা করা অভিযোগও আছে। মোটকথা, ধর্মীয় শিক্ষাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আলাদা করা ধর্মশিক্ষাকে উপেক্ষা করারই চূড়ান্ত রূপ।
আট. প্রাথমিক শিক্ষার অধ্যায়ে ‘শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি’ শিরোনামের অধীনে ৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার ধারা নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থীকে নির্দিষ্ট শ্রেণীর পাঠ্যসূচি অনুযায়ী নির্ধারিত বিষয়সমূহ অর্থাৎ বাংলা, ইংরেজি, নৈতিক শিক্ষা, বাংলাদেশ স্টাডিজ, গণিত, সামাজিক পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণাসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিচিতি এবং তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বাধ্যতামূলকভাবে পড়তে হবে।’ পৃষ্ঠা-৫
মন্তব্য : কার্যক্ষেত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে ধর্মশিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় একজন শিশু তৃতীয় শ্রেণিতে উঠার আগে তিন বছর পর্যন্ত একবারের জন্যও আল্লাহ, নবী-রাসূল, জান্নাত-জাহান্নাম, খেলাফাহ-জিহাদ ইত্যাদির মতো ইসলামী শব্দগুলো শুনতে পাবে না। এর বিপরীতে সাহিত্যের নামে তার কচি হৃদয়ে গেঁথে দেয়া হবে মিথ্যা বানোয়াট কল্পকাহিনী। শেখানো হবে ইসলামে নিষিদ্ধ নানা প্রাণীর ছবি আঁকাআঁকি। সহশিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে তৈরি করে দেয়া হবে অবৈধ প্রেম-ভালোবাসার সুযোগ। পরে বড় হয়ে যখন এরা শুনবে যে ইসলামে ছবি আঁকা নিষেধ, হুজুররা জিহাদের কথা বলে, প্রেম ভালোবাসাকে অবৈধ বলে, তখন তারা আঙ্গুল তুলতে শুরু করবে যে হুজুররা সেকেলে। এখনো অন্ধকারেই পড়ে আছে। জিহাদকে তখন তারা সন্ত্রাস হিসেবে চিহ্নিত করবে।
নয়. ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা অধ্যায়ে ‘কৌশল’ শিরোনামের ক নম্বর ধারায় ‘ইসলামধর্ম শিক্ষা’ শিরোনামের অধীনে বলা হয়েছে, ‘শিক্ষার্থীদের মনে আল্লাহ, রাসুল (সা:) ও আখিরাতের প্রতি অটল ঈমান ও বিশ্বাস যাতে গড়ে ওঠে এবং তাদের শিক্ষা যেন আচার সর্বস্ব না হয়ে তাদের মধ্যে ইসলামের মর্মবাণীর যথাযথ উপলব্ধি ঘটায় সেভাবে ইসলাম ধর্ম শিক্ষা দেয়া হবে।’ পৃষ্ঠা-২০
মন্তব্য : এখানে ‘তাদের শিক্ষা যেন আচার সর্বস্ব না হয়ে তাদের মধ্যে ইসলামের মর্মবাণীর যথাযথ উপলব্ধি ঘটায়’ অংশে সুক্ষ্মভাবে ইসলামের ইবাদত, আমল, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যকার দৃশ্যমান সংস্কৃতিকে খাটো করে দেখানো হয়েছে। অথচ ইসলাম কখনোই আচার সর্বস্ব ধর্ম ছিল না। এখনো নেই। বরং ইসলাম সর্বযুগের উপযোগী। ইসলামে রয়েছে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রায়োগিক ও সফল জীবন ব্যবস্থা। ইসলামে এ সকল বৈশিষ্ট্য থাকায় বহু অমুসলিম পণ্ডিত ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হয়েছেন।
মোটকথা, পুরো শিক্ষানীতিকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যার পরতে পরতে বিষাক্ত সেক্যুলারিজমের বিষাক্ত বীজ বপন করা আছে। অথচ একটি মুসলিম প্রধান দেশের শিক্ষানীতি হওয়ার কথা ছিল তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ, চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আক্বীদা-বিশ্বাস ও কৃষ্টি-সভ্যতা ইত্যাদির সমন্বয়ে ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন। তথাপি মুখবন্ধ-এ তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ লিখেছেন যে ‘এটা কোন দলীয় শিক্ষানীতি নয়– জনগণ তথা জাতির আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটিয়ে তৈরি করা হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতি।’ সেজন্য প্রশ্ন জাগে গুটিকতেক সেক্যুলারই কি তাহলে বাংলাদেশ? তাদের আকাঙ্ক্ষাই কি ৯০ শতাংশ মুসলিমের আকাঙ্ক্ষার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
এছাড়া পূর্বের দুই শিক্ষানীতিতে যদিও মুসলিমদের প্রত্যাশার যথাযথ প্রতিফলন ছিল না। কিন্তু সেগুলো এতটা সেক্যুলারিজমে আক্রান্ত ছিল না। কিন্তু কবির চৌধুরীর এই শিক্ষানীতি এতটাই সেক্যুলারঘেঁষা যে তা আগের দুই শিক্ষানীতির চেয়ে দুই কাঠি সরোস।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. কুদরাত এ খুদার নেতৃত্বে দেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছিল। উক্ত কমিশন ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গণমুখী আধুনিক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে অবৈধ ক্ষমতা দখলের পালা শুরু হয়। ফলে ড. কুদরাত এ খুদা প্রণীত শিক্ষানীতি আর বাস্তবায়িত হয়নি। বরং জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরনে কোন পদক্ষেপই নেয়া হয়নি।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একুশ বছর পর ক্ষমতায় এসে পুনরায় শিক্ষানীতি প্রণয়নে পদক্ষেপ নেয়। ১৯৯৭ সালে রিপোর্ট প্রস্তুত করা হয়। উক্ত প্রতিবেদনের আলোকে ‘শিক্ষানীতি-২০০০’ প্রণীত হয়। কিন্তু ক্ষমতার পট পরিবর্তন হওয়ায় আবারও শিক্ষানীতি ফেলে দেয়া হয় আস্তাকুঁড়ে। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে আমরা সরকারের দায়িত্ব নেবার পর নির্ধারিত লক্ষ্যকে সামনে রেখে পূর্বে প্রণীত শিক্ষানীতিকে যুগোপযোগী করে প্রণয়ন করার জন্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের দায়িত্ব প্রদান করা হয় এবং সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের মতামত গ্রহণ করা হয়। সকলের মতামতকে গুরুত্ব দেয়ার কারণে এই শিক্ষানীতি সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা পায়। সূত্র : শেখ হাসিনার প্রাক কথন জাতীয় শিক্ষানীতিতে।
চলবে…
লেখক : পরিচালক, নদওয়াতুল হানাফিয়া বাংলাদেশ
শাপলা চত্বরে ৫ মে’র শহীদদের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ হেফাজতের