গাজায় নিহতের সংখ্যা লাখের কাছাকাছি বলে দাবি করেছে ইসরাইলি পত্রিকা হারেৎজ। তারা সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক গবেষকদল পরিচালিত সমীক্ষার ভিত্তিতে এই দাবি করেছে।
সূত্রটি জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরাইলি আগ্রাসনে গাজা উপত্যকায় প্রায় ১ লাখ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এই সংখ্যা সরাসরি বোমা হামলা ও সহিংসতায় প্রাণ হারানো এবং যুদ্ধের পরোক্ষ প্রভাব যেমন ক্ষুধা, রোগ ও চিকিৎসাসেবার অভাব থেকে উদ্ভূত মৃত্যুর সমন্বিত হিসাব। হারেৎজের মতে, এ পরিসংখ্যান গাজা সংঘর্ষকে একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরিণত করেছে।
পত্রিকাটি একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা দল পরিচালিত সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করেছে। সেখানে দাবি করা হয়েছে, গাজায় নিহতের প্রকৃত পরিসংখ্যান, ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে তথ্য দিয়ে থাকে, তা বাস্তবতার তুলনায় রক্ষণশীল এবং প্রকৃত চিত্রকে অনেকটাই আড়াল করে। এই সমীক্ষা পরিচালনা করেছেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়্যাল হলওয়ে কলেজের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাইকেল স্পাগাট, যিনি ইরাক, সিরিয়া ও কসোভোসহ একাধিক সঙ্ঘাত নিয়ে গবেষণা করেছেন।
ড. খলিল শিকাকির সহায়তায় পরিচালিত গবেষণায় গাজার দুই হাজার পরিবারের উপর জরিপ চালানো হয়, যার আওতায় প্রায় ১০ হাজার মানুষের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত গাজায় প্রায় ৭৫ হাজার ২০০ জন ফিলিস্তিনি সহিংসতায় নিহত হয়েছে। তাদের অধিকাংশ ইসরাইলি অস্ত্রের আঘাতে নিহত হয়েছেন। একই সময়ে ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব ছিল ৪৫ হাজার ৬৬০ জন, যা প্রকৃত সংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ কম বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
গবেষণাটিকে যদিও এখনো পিয়ার-রিভিউ করা হয়নি এবং এটি একটি প্রাথমিক সংস্করণ, তবে এর ফলাফল ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের গবেষকদের পরিচালিত অন্য একটি গবেষণার সাথে মিলে গেছে, যেখানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানকে প্রায় ৪০ শতাংশ অবমূল্যায়ন বলে অভিহিত করা হয়েছিল।
গবেষণায় যুদ্ধের পরোক্ষ প্রভাব থেকেও বিপুল প্রাণহানির প্রমাণ পাওয়া গেছে। স্পাগাটের মতে, সহিংসতা, রোগ ও ক্ষুধার সম্মিলিত কারণে অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৩ হাজার ৭৪০ জনে। আর এরপর থেকে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরো ১০ হাজার মৃত্যু নিশ্চিত করেছে, যা এখনো অতিরিক্ত মৃত্যুর হিসাবের বাইরে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা এখন ১ লাখের কাছাকাছি পৌঁছেছে।
স্পাগাট বলেন, এই সংখ্যা গাজার সংঘর্ষকে একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংঘর্ষগুলোর একটি হিসেবে চিহ্নিত করে। যদিও সিরিয়া, ইউক্রেন ও সুদানে মোট নিহতের সংখ্যা বেশি। তবে গাজায় নিহতদের মধ্যে বেসামরিক মানুষের অনুপাত এবং জনসংখ্যার তুলনায় মৃত্যুর হার অন্যান্য সব যুদ্ধকে ছাড়িয়ে গেছে।
গবেষণায় উঠে এসেছে আরো কিছু বিস্ময়কর পরিসংখ্যান। জরিপ অনুযায়ী, নিহতদের ৫৬ শতাংশই ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু ও নারী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী প্রায় সব সঙ্ঘাতের তুলনায় এ সংখ্যা ব্যতিক্রমীভাবে বেশি। অন্যদিকে, কসোভো, সিরিয়া, ইরাক, সুদান ও ইথিওপিয়ার মতো অন্যান্য সঙ্ঘাতে নারী ও শিশু নিহতের হার ছিল যথাক্রমে ২০ শতাংশ, ২০ শতাংশ, ১৭ শতাংশ, ২৩ শতাংশ ও ৯ শতাংশ।
স্পাগাট জানান, গাজায় জনসংখ্যার তুলনায় মৃত্যুর হার প্রায় ৪ শতাংশে পৌঁছেছে, যা একবিংশ শতাব্দীতে আর কোথাও দেখা যায়নি।
গবেষণার ফলাফলের বিপরীতে, ইসরাইলি সরকার ও সামরিক বাহিনী গাজায় বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য প্রকাশ করেনি। শুধু হামাস ও অন্যান্য গোষ্ঠীর প্রায় ২০ হাজার যোদ্ধা নিহত হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু সে সংখ্যার পক্ষে কোনো নাম বা প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। স্পাগাট জানান, তার দল কিছু যোদ্ধার নাম সনাক্ত করতে পারলেও তা কয়েক শ’র বেশি নয়, এক হাজারেও পৌঁছায়নি।
এই গবেষণার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন শুধু একটি সামরিক অভিযান নয়। বরং তা একবিংশ শতাব্দীর এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে।
সূত্র : আল জাজিরা