টুডেনিউজ বিডি ডটনেট
আমি কেবল উম্মাহর একজন সদস্যই নই। আমি গাজার একটি বাস্তব গল্প। আমি কেবল একটি সংখ্যাই হতে চাই না। আমি চাই, আমার জীবনটুকু কেউ মনে রাখুক। আমার গল্পটা যেন কোনো হারানো আত্মার মতো নিঃশব্দে মুছে না যায়। আমি যেন কোনো ‘অজানা ব্যক্তি’ হয়ে কালের গহ্বরে হারিয়ে না যাই।
আমি অনেক সময় ভাবতাম, আমি কখনো মৃত্যু কল্পনাই করতে পারতাম না। আমি কখনো ভাবিনি যে মৃত্যু এত কাছে চলে আসবে, এমনভাবে যে প্রতিটি মুহূর্তে তা আমার হৃদয়ে গাঁথবে। ছোটবেলায় মনে হতো, মৃত্যু হঠাৎ আসে। আমরা তা কোনোভাবেই অনুভব করতে পারি না। কিন্তু এই যুদ্ধে, মৃত্যু যেন ধীরে ধীরে, একেবারে আমাদের শরীরে, মনে, আত্মায় ঢুকে গেছে। তা যেন অনুভব করানো হয় প্রতিটি মুহূর্তে।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, আমি একটা অদ্ভুত কষ্ট অনুভব করতে শুরু করলাম। এমন কষ্ট যে আমরা যুদ্ধের শব্দের সাথে এক হয়ে শ্বাস নিতে বাধ্য হয়েছি। যুদ্ধের আগের সময় মৃত্যু শুধুই একটা ভয় ছিল। ছিল একটা ধারণা। কিন্তু এখন তা আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের সামনে এক অজানা ভবিষ্যতের ভয় নিয়ে আসে। মনে পড়ে, নেটজারিম এলাকা থেকে ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক যখন প্রবেশ করছিল, সেই মুহূর্তটা যেন কল্পনাতীত ছিল। আমি হতবাক হয়ে পাঠিয়েছিলাম বার্তা, ‘তারা কিভাবে গাজায় প্রবেশ করল? আমি কি স্বপ্ন দেখছি?!’
আমার ভেতরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছিল, একটি অপেক্ষা ছিল- যতক্ষণ না তারা চলে যাবে, যতক্ষণ না আমরা আবার শান্তিতে নিশ্বাস নিতে পারব। আমি আশা করেছিলাম যে একদিন গাজা আবার মুক্ত হবে, শান্তির এক অনন্ত সম্ভাবনা ফিরে আসবে। কিন্তু আজ, তারা আমার খুব কাছে- আল-ফুখারিতে, খান ইউনিসের পূর্বে এবং রাফাহের উত্তরে। আমার আশপাশে এক ভয়ানক শব্দ বাজে, পৃথিবীটা যেন প্রতিদিন আমাদের ভয়াবহ বিস্ফোরণের মধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
এই যুদ্ধ, যা আমি আগে কখনো অনুভব করিনি, তা আমাকে ভিন্নভাবে ছিঁড়ে ফেলেছে। এখানে যুদ্ধ শুধু শারীরিক আঘাত নয়, এর মাঝে লুকিয়ে রয়েছে এক গভীর মানসিক যন্ত্রণা, এক অন্তহীন অশান্তি। আমি তাদের কথা মনে করি- শহীদদের, যারা কোনো চিহ্নিত নাম ছাড়াই পৃথিবী থেকে চলে গেছেন, যাদের শরীরের কোনো অংশও সনাক্ত করা যায়নি। তাদের মুখে যদি লেখা থাকে ‘কালো বা নীল ব্লাউজ পরা একজন যুবতী‘। তবে আমার কি আর কোনো পরিচয় থাকবে?
আমি চাই, আমি যেন শুধুই একটি সংখ্যা না হয়ে থাকি। আমি যেন আমার গল্পটা পৃথিবীকে শোনাতে পারি। আমি গাজার সেই মেয়ে, যে ২০০৬ সালে গাজা শহরের অন্ধকার কোণে গড়ে উঠেছিল। আমি সেই মেয়ে, যে যুদ্ধের ভয়াবহ অবরোধের মধ্যে, বহু কষ্টের মধ্যে, কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও উচ্চ বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছিল। আমি শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করলাম। কিন্তু যখন অবরোধ ও বেকারত্ব সবকিছু তছনছ করে দিলো, আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না।
আমি গাজার শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেছি। ১৯৪৮ সালে, যখন আমার দাদারা নিজেদের জমি হারিয়েছিলেন, তখন তারা গাজায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমিও সেই শিবিরে বড় হয়েছি। কিন্তু কখনোই শান্তি পেলাম না। ২০০০ সালে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আমাদের বাড়ি ভেঙে দেয় এবং আমাদের দুই বছর আশ্রয়হীন করে রাখে। তারপর ২০০৩ সালে, জাতিসঙ্ঘ আমাদের জন্য একটি নতুন বাড়ি দেয় আল-ফুখারিতে। কিন্তু তাও ছিল সীমিত, ছোট এবং অসুবিধাজনক।
আমরা সেখানেও শান্তি পাইনি। আমাদের বেঁচে থাকার লড়াই অব্যাহত ছিল। কিন্তু একসময় আমি কাজে বেরিয়েছিলাম, নিজের বাবাকে সাহায্য করতে, যাতে আমরা একটু ভালো জীবন কাটাতে পারি। কাজ করে আমি কিছুটা আর্থিক সচ্ছলতা পেয়েছিলাম ২০১৫ সালে। তবে বাস্তবতা আমাকে বারবার পরীক্ষা নিয়ে আসে- যখন যুদ্ধ এসে আমাদের সব কিছু ধ্বংস করে দেয়, আমি বুঝতে পারি, কী কঠিন ছিল এই যুদ্ধের আগে কাটানো বছরগুলো।
এটা ছিল আমাদের স্বপ্নের বাড়ি, কিন্তু যুদ্ধ এসে সব কিছু ধ্বংস করে দেয়। যেটা ছিল আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন, সেটি এক রাতেই হারিয়ে যায়। যুদ্ধ, অবরোধ, এসব কিছুর পরেও, আমি শক্ত থাকার চেষ্টা করেছি। ভেবেছি, যদি আমি একটু শক্তি যোগাতে পারি, তবে অন্তত চারপাশের মানুষজন একটু আশার আলো দেখতে পাবে।
যুদ্ধের সময় আমি কখনো কান্না করতে পারিনি। আমি শক্ত থাকার চেষ্টা করেছি, যতটুকু সম্ভব। কিন্তু এই শক্তি কখনোই অনন্ত ছিল না। আমি জানতাম, যদি আমার দুর্বলতা প্রকাশ পায়, তবে আমি একে একে ধ্বংস হয়ে যাব। তাই আমি মুখে হাসি নিয়ে, ভেতর থেকে নিজের কষ্ট চাপা দিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়েছি।
যুদ্ধবিরতির সময় আমি আশা করেছিলাম, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তখনো জানতাম না, এই যুদ্ধ শেষ হয়নি। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার বেঁচে থাকার লড়াইও শেষ হবে না।
যুদ্ধ আবার ফিরে এলো। কিন্তু এবার এটি আগের চেয়েও কাছে এসে গেল। আমি এক অবিরাম আতঙ্কের মধ্যে বাস করছিলাম, যেখানে গোলাবর্ষণ এবং বিস্ফোরণের শব্দ আমাদের প্রতিটি শ্বাসে ভীতির সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। তারা আমাদের বিরুদ্ধে একের পর এক ভয়ঙ্কর অস্ত্র ব্যবহার করছিল- রকেট, বিমান, ট্যাঙ্কের গোলা। ট্যাঙ্কগুলো গুলি চালাচ্ছিল, নজরদারি ড্রোনগুলো আকাশে উড়ে চলছিল; সবকিছুই ছিল এক অসহ্য ভয়ের পরিবেশ।
এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে আমি ঘুমাইনি। যদি কখনো আমি ঘুমিয়ে পড়ি, বিস্ফোরণের তীব্র শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যেত। তখন আমি দৌড়াতে শুরু করতাম। কিন্তু জানতাম না কোথায় যাচ্ছি। শুধু ঘরের মধ্য দিয়ে ছুটে চলতাম, যেন কিছুই আমাকে থামাতে না পারে।
এই ক্রমাগত আতঙ্কের মধ্যে, আমি এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্রাম নিতে পারতাম না। আমার বুকে হাত রেখে ভাবতাম, ‘এটা আর কতটা সহ্য করা সম্ভব?’ প্রতিটি মুহূর্তের সাথে সেই ভয়ের অনুভূতিটি আরো গভীর হতে থাকতো। সেদিন আমি আমার সব বন্ধুদের কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলাম, তাদের বলেছিলাম যেন আমার গল্পটি কেউ শুনে। যেন আমি কেবল একটি সংখ্যা না হয়ে থাকি।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী যখন আমার চারপাশের এলাকা ধ্বংস করতে শুরু করেছিল, তখন আমরা অসহনীয় দিনগুলোর মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। এখানে এখনো অনেক পরিবার বাস করছে, যারা চলে যেতে চায় না। কিন্তু বাস্তুচ্যুতি, শারীরিক, আর্থিক এবং মানসিকভাবে তাদের দুর্বল করে দিয়েছে।
প্রথম বাস্তুচ্যুতি আমার জীবনে ঘটেছিল ২০০০ সালে, যখন আমার বয়স ছিল প্রায় আট বছর। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বুলডোজার যখন খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে ঢুকে আমাদের মামা ও দাদার বাড়ি ধ্বংস করেছিল, তখন আমি সেই স্মৃতিগুলি হারানোর যন্ত্রণা অনুভব করি। সে সময় আশ্চর্যজনকভাবে তারা আমাদের বাড়িতে থামতে বাধ্য হয়েছিল।
আমরা তখন সেই ধ্বংসের মাঝেই একটি জীর্ণ বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। রমজান মাস ছিল এবং আমার বাবা-মা ভেবেছিলেন যে কিছুদিন পর আমরা ফিরে আসতে পারব। কিন্তু আমি সহ্য করতে পারছিলাম না সেই বাড়ি হারানোর কষ্ট। তাই আমি মাঝে মাঝে গিয়ে, দাদা-দাদির সাথে কাটানো সুন্দর স্মৃতির জায়গায় কিছু জিনিসপত্র নিয়ে আসতাম।
একদিন ঈদের আগের রাতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আমাদের বাড়িটি ভেঙে ফেলে। ঈদের প্রথম দিন, আমি এবং আমার পরিবার সেখানে গিয়ে ঈদ উদযাপন করেছিলাম- ধ্বংসস্তূপের উপর, নতুন ঈদের পোশাক পরে। আমাদের হাতে কোনো কিছুই আর ছিল না। আমাদের হৃদয়ে শুধু দুঃখ এবং শূন্যতা।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আমাদের কিছু রাখতে দেয়নি, সবকিছু ধ্বংস করে, আমাদের হৃদয়ে শুধু ক্ষত রেখে গেছে। এই ভয়াবহ শক্তির বিরুদ্ধে যদি পৃথিবী আমাদের রক্ষা না করে, তাহলে ভবিষ্যত কী হবে, আমি জানি না।
আমি জানি না আমার হৃদয় আর কতটা এই অন্তহীন শব্দ সহ্য করতে পারবে। আমি চাই, আমাকে কেউ কখনো ভুলো না। আমার জীবনের জন্য আমি কঠোর লড়াই করেছি। একজন সাংবাদিক এবং শিক্ষক হিসেবে আমি ১০ বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম করেছি, নিজেকে উৎসর্গ করেছি।
আমার ছাত্ররা, যাদের আমি খুব ভালোবাসি এবং সহকর্মীরা, যারা আমার জীবনের অংশ, তাদের সাথে আমি অনেক সুন্দর স্মৃতি রচনা করেছি।
গাজার জীবন কখনোই সহজ ছিল না, কিন্তু আমরা এই জীবনটিকে ভালোবাসি, কারণ আমাদের কোনো অন্য জীবনের কথা ভাবতে পারি না। এখানে আমাদের শিকড়, আমাদের হৃদয়ের গভীরে গাজার পৃথিবী।
সূত্র : আল জাজিরা