গাজা যুদ্ধ নিয়ে ইসরাইলি গণমাধ্যম যা কিছু প্রকাশ করে, তা যে সত্যের সবটুকু নয়, পাঁচ তরুণ ইসরাইলি সৈন্য হারেৎজ পত্রিকাকে ওই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তারা বলছেন, গাজার যুদ্ধে তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা গণমাধ্যমে উপস্থাপিত চিত্রের একেবারে বিপরীত।
হারেৎজ জানিয়েছে, এই পাঁচজন রিক্রুটকে স্কুল শেষ করেই গাজায় পাঠানো হয়েছিল, যেখানে তারা প্রায় ২১ মাস ধরে লড়াই করছে।
তারা হামাসের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধকে ‘তিক্ত ও ক্লান্তিকর’ আখ্যা দিয়ে বলেছে, এটি এমন এক যুদ্ধ যা হতাশা, ক্ষোভ ও পক্ষাঘাতের ভয় সঞ্চার করে।
পত্রিকাটি বলছে, যুদ্ধরত সৈন্যদের অভিজ্ঞতা সাধারণত জনসাধারণের অজানা থেকে যায়। এমনকি সাংবাদিকরা যখন যুদ্ধ ইউনিটে যোগ দেন, তখনও তারা যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তব চিত্র দেখতে পান না। দেখা যায়, যা তাদের দেখানো হয়, তা পূর্ব-পরিকল্পিত ও সাজানো দৃশ্য।
আইডিএফের মুখপাত্র ও কমান্ডাররা সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার জন্য নির্দিষ্ট সৈন্য নির্বাচন করেন। তাদের বলে দেন যে কী বলতে হবে, আর কী বলা যাবে না। এতে সাংবাদিকেরা সৈন্যদের ‘সিংহের প্রজন্ম’ বলে অভিহিত করেন এবং তাদের ‘উচ্চ মনোবল’ নিয়ে লেখেন।
কিন্তু হারেৎজের সাথে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কথা বলা সৈন্যরা ভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছেন। তাদের বক্তব্যে এমন একটি বাস্তবতা উঠে এসেছে, যা সরকারি বিবৃতির সাথে যার মিল খুবই সামান্য।
তারা বলেছেন, ক্রমাগত ক্লান্তি, চরম শারীরিক ও মানসিক চাপ এবং মৃত্যু আতঙ্কে ভুগছেন তারা। প্রতিনিয়ত ভয়ের মধ্যে থাকেন যে এবারই হয়তো তাদের পালা।
এদের অধিকাংশই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থাকলেও পাঁচজন সৈন্য কথা বলেছেন, যাদের একটাই অনুরোধ, আপনারা আমাদের যুদ্ধ করতে পাঠিয়েছেন, এখন অন্তত আমাদের কথা শুনুন ‘
কেফির ব্রিগেডের ইয়োনাতান (২১)
ইয়োনাতান কেফির ব্রিগেডের একজন পদাতিক সৈনিক। তিনি বর্ণনা করেছেন কিভাবে গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে প্রবেশের পর তারা এক ভয়াবহ ঘটনার মুখোমুখি হন।
একটি বাড়ির কাছে অবস্থান করার সময় একদল কুকুর এসে ঘেউ ঘেউ করতে থাকে। ডেপুটি কমান্ডার আতঙ্কিত হয়ে একে একে কুকুরগুলোকে গুলি করেন এবং সৈন্যদের বলেন, ‘এরা সন্ত্রাসী কুকুর, ওরা পাগল হয়ে যেতে পারে।’
পরদিন যখন তারা সেই বাড়িটি পরিষ্কার করতে যায়, তখন একটি বিস্ফোরণে ইয়োনাতান শূন্যে উঠে যান। তিনি বলেন, আমার মুখ তখন রক্তে ভরে গিয়েছিল। ভাবলাম আমি আহত হয়েছি। পরে বুঝি যে এটা আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর রক্ত, যাকে দ্রুত সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। এরপর আমি আর ঘুমাতে বা খেতে পারিনি।’
তিনি আরো বলেন, একবার কমান্ডার তাকে রাত ২টায় পাহারার দায়িত্ব দেন। কিছুক্ষণ পর শ্বাসকষ্ট অনুভব করায় সে মুখ ধোয়ার জন্য সরে যায়। পরে অফিসার তাকে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ২৮ দিনের কারাদণ্ড দেন।
প্যারাট্রুপার্স রিকন ইউনিট সদস্য ওরো (২০)
ওরো বলেন, খান ইউনিসের একটি বিধ্বস্ত বাড়ির ধ্বংসস্তূপে তারা পাঁচ বা ছয়টি লাশ দেখতে পান, যেগুলো ক্ষুধার্ত কুকুরে খেয়ে ফেলেছিল বলে মনে হচ্ছিল। মৃতদের মধ্যে দু’জন ছিল ছোট শিশু। ‘এই দৃশ্য ভয়াবহ ও অবিস্মরণীয়।’
গিভাতি ব্রিগেড সদস্য ওমর (২১)
ওমর বলেন, ‘আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না যে এই যুদ্ধ মাত্র ২০ মাস ধরে চলছে। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় আমার মনে হয়, যুদ্ধটা যেন ১০ বছর ধরে চলছে।’
তিনি বলেন, ‘৭ অক্টোবর ২০২৩-এর পর আমরা গাজা যাওয়ার প্রস্তুতি নেই। তখন উত্তেজনায় ভরা ছিলাম। এখন মনে হয়, সেটা ছিল একটা বোকামি। আমি ভুলে গেছি কতজন পরিচিত নিহত হয়েছেন আমার ব্যাটালিয়ন, ব্রিগেড, স্কুল, পাড়া থেকে।’
তিনি বলেন, ‘মানুষ ভাবে সৈন্যরা যুদ্ধে মারা যায়। কিন্তু অনেকেই মারা গেছে অফিসারদের অবহেলা বা অস্ত্রের অভাবে। পরে মিডিয়া জানায়, তারা আইইডি থেকে নিহত হয়েছেন। এটাই সবাই মেনে নেয়। কেউ ভাবেও না। কতজন বন্ধুকে কবর দিতে হবে, মানুষ জেগে ওঠার আগে?’
নাহাল রিকন ইউনিট সদস্য ইয়ার (২১)
ইয়ার বলেন, বেইত লাহিয়ার কাছে রাত ২টায় ঘুমন্ত অবস্থায় ১০ জন সৈন্যের দল অতর্কিত হামলার শিকার হয়। তিনি বলেন, আমি হঠাৎ জেগে উঠে ভয় পেয়ে যাই। অফিসারকে জাগালে, তিনি আতঙ্কে চিৎকার শুরু করেন। এরপর তিনি পুরোপুরি মেজাজ হারিয়ে ফেলেন।’
তিনি জানান, দিনভর ঘুমাতে না দিয়ে রাতভর অভিযান চালানোয় সৈন্যরা ধীরে ধীরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। এমনকি তার পরিবার ও বান্ধবীর সাথে পর্যন্ত খারাপ আচরণ করতে শুরু করে। একপর্যায়ে মানসিক চাপে তার চুল পড়তে শুরু করে।
তিনি আরো বলেন, এই চাপ আমাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমাদের একটি পুরো স্কোয়াড নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আমি বেঁচে আছি। কিন্তু তাও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত।’
ইয়াহালোম ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিট উরি (২২)
উরি বলেন, ‘একসময় আমি বিশ্বাস করতাম যে আমরা ইতিহাস রচনা করছি; বন্দিদের উদ্ধারে সহায়তা করছি; নাগরিকদের রক্ষা করছি। কিন্তু ধীরে ধীরে সন্দেহ জন্ম নিতে শুরু করে। দেখলাম, এক বন্দী বিমান হামলায় মারা গেল। আরেক বন্ধুর জানাজা… এরপর থেকে সবকিছু বদলে যায়।’
তিনি বলেন, ‘আমি আর কোনো অভিযানে যেতে পারি না। সেই একই এলাকা, সেই একই সুড়ঙ্গ, সেই একই বিপদ… আর কতবার? কিসের জন্য? যে কেউ দেখলেই বুঝবে, এই যুদ্ধ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে চলছে। কিছুই অর্জিত হচ্ছে না। শুধু আমাদের জীবন বিপন্ন হচ্ছে।’
শেষে তিনি বলেন, ‘কবে বুঝবে যে যুদ্ধ থামানোর সময় এসেছে? ৯০০ জন মরলে? ১,০০০? দয়া করে থামো। কথা বলো। প্রতিবাদ করো। যেন মৃত্যুর সংখ্যা আর না বাড়ে।’
সূত্র: হারেৎজ