টুডেনিউজ বিড ডটনেট
শিশুরা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে খালি পায়ে হাঁটছে। তারা অন্য শিশুদের বহন করছে। ছোট ভাইবোনদের জড়িয়ে রাখছে। পরিবারের শেষ স্মৃতিগুলো আঁকড়ে আছে।
গাজায় নেই কোনো নিরাপত্তা, নেই নীরবতা, নেই বিরতি। শুধু ছুটে চলা- পালিয়ে যাওয়া, কবর দেয়া, আবার পালিয়ে যাওয়া। বোমা তাদের তাড়া করছে, ট্যাঙ্ক রাস্তায় ধাওয়া করছে, ড্রোন মাথার ওপরে গুঞ্জন করছে। সব যেন হামলার জন্য অপেক্ষায় থাকে।
তাদের মুখ আমরা দেখেছি- কেউ ছাইয়ে ঢাকা, কাঁদতেও পারছে না; কেউ ধুলোয় ধূসরিত অবস্থায় এমন নাম নিয়ে চিৎকার করছে- যে নাম আর কোনোদিন সাড়া দেবে না। অনেক শিশু এক কবর থেকে আরেক কবরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
অনেকের নামও নেই, কেবল একটি সংখ্যা আছে- তাদের বাহুতে কলমে লেখা, যেন মৃত্যুর পরেও তাদের পরিচয় জানা যায়।
পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ
এই মাসের শুরুতে ভোরের আগে ইসরাইলি হামলায় প্রায় ২০০ শিশু নিহত হয়। তারা যুদ্ধে বা ভুলক্রমে মারা যায়নি; তারা ঘরে, তাঁবুর নিচে, ঘুমের মধ্যে মারা গেছে। তাদের দেহ কম্বলে মোড়ানো ছিল, ছাদ ধসে তাদের চাপা দিয়েছে।
যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত জিপি হোটোভেলি এই গণহত্যা নিয়ে প্রশ্নের মুখে কোনো অনুশোচনা দেখাননি, এমনকি ‘শিশু’ শব্দটিও উচ্চারণ করেননি। তিনি শুধু হামাস, মানব ঢাল ও আত্মরক্ষার পুরনো যুক্তি দিয়েছেন।
গোপন করার কৌশল
ইসরাইলে এই হত্যাকাণ্ডকে ‘উগ্রবাদীদের নির্মূল’ হিসেবে দেখানো হয়। কোনো নাম, কোনো বয়স প্রকাশ করা হয় না। ইসরাইলি সাংবাদিক অরলি নয়ের মতে, ‘গাজায় নিরপরাধ কেউ নেই’। হাঁ, এমন দাবিই করা হয়। এটি মিডিয়ার ব্যর্থতা নয়। বরং ইসরাইলের পরিকল্পিত প্রচারণা।
কিন্তু বিশ্ব দেখছে, একের পর এক ছোট ছোট লাশ গণনা করছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ১৮ হাজারেরও বেশি শিশু নিহত হয়েছে, যাদের অনেকে এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে।
পরিকল্পিত অনাহার
এক বছর আগে ইউনিসেফ জানিয়েছিল, উত্তর গাজায় দুই বছরের কম বয়সী প্রতি তিনটি শিশুর একজন তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। খান ইউনিসে, ২৮ শতাংশ শিশু অনাহারে আছে, ১০ শতাংশেরও বেশি মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে।
গাজায় এখন হাসপাতাল নেই, ওষুধ নেই, বিশুদ্ধ পানীয় জল নেই। প্রতি ২২০ জনের জন্য একটি টয়লেট, প্রতি ৪ হাজার ৫০০ জনের জন্য একটি ঝরনা। অনাহার, রোগ ও চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু এখানে নতুন অস্ত্র হয়ে উঠেছে।
শারীরিক নির্যাতন ও অঙ্গচ্ছেদ
প্রতিদিন প্রায় ১০টি শিশুর অঙ্গচ্ছেদ করা হচ্ছে। অ্যানেস্থেসিয়া ছাড়া, অন্ধকার কক্ষে, টর্চের আলোয় অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে। এখন গাজায় মাথাপিছু বিশ্বে সবচেয়ে বেশি শিশু অঙ্গচ্ছেদ হয়েছে।
গাজার হাসপাতালগুলোতে এখন একটি নতুন শব্দ চালু হয়েছে, WCNSF- আহত শিশু, যার কোনো জীবিত পরিবার নেই। এরা এমন এতিম, যাদের নাম বলার মতোও কেউ নেই।
অধিকৃত পশ্চিমতীরে শিশুদের নির্যাতন
প্রতি বছর ৫০০-৭০০ ফিলিস্তিনি শিশু- যাদের মধ্যে কেউ কেউ মাত্র ১২ বছরের- ইসরাইলি সামরিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি হয়। সবচেয়ে সাধারণ অভিযোগ, পাথর ছোড়া।
তাদের গভীর রাতে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, চোখ বাঁধা হয়, বাবা-মা বা আইনজীবী ছাড়া জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। অনেক শিশুকে মারধর করা হয়, হুমকি দেয়া হয়, এমনকি হিব্রু ভাষায় লেখা স্বীকারোক্তিতে স্বাক্ষর করতেও বাধ্য করা হয়, যা তারা বুঝতে পারে না।
১৪ বছর বয়সী মুইন গাসসান ফাহেদ সালাহাত সবচেয়ে কমবয়সী ফিলিস্তিনি শিশু, যে কোনো অভিযোগ ছাড়াই আটক রয়েছে। তার মুক্তির কোনো সময়সীমা নেই।
শিশুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
২০০০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১৩ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি শিশুকে ইসরাইলি বাহিনী গ্রেফতার করেছে।
ডিফেন্স ফর চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল-প্যালেস্টাইনের তথ্য অনুযায়ী, দ্বিতীয় ইন্তিফাদা থেকে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইসরাইলি বাহিনীর হাতে কমপক্ষে ২ হাজার ৪২৭ জন ফিলিস্তিনি শিশু নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ৭ অক্টোবর ২০২৩-এর পর গাজায় নিহত শিশুরা অন্তর্ভুক্ত নয়।
এই হত্যাকাণ্ড কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি পরিকল্পিত নীতি। শিশুদের হত্যা, অনাহারে রাখা, চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা- সবকিছুই এই পরিকল্পনার অংশ।
প্রশ্ন থেকে যায়, কোনো রাষ্ট্র কি শিশুদের বিরুদ্ধে এমন যুদ্ধ চালায় এবং একে আত্মরক্ষা বলে?
২০২৩ সালের শেষের দিকে, বন্দী বিনিময়ের সময় ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনি বন্দীদের আদান-প্রদান করা হয়। ফিলিস্তিনি বন্দীদের মধ্যে অনেকেই ছিল নাবালক। কিন্তু বিবিসি ও গার্ডিয়ানের মতো গণমাধ্যম প্রথমে তাদের ‘শিশু’ বলতে চায়নি। তারা ‘কিশোর’ বা ‘১৮ বছর বা তার কম বয়সী ব্যক্তি’ বলে উল্লেখ করেছিল। এই ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের শৈশব, নির্দোষতা ও সহানুভূতি কেড়ে নেয়া হয়। ফলে তাদের বন্দিত্বকে স্বাভাবিক বলে মনে করা হয়।
শিশুদের হুমকি হিসেবে উপস্থাপন
এটি কেবল একটি শব্দচয়নের বিষয় নয়, বরং একটি সুপরিকল্পিত প্রচারণার অংশ। ফিলিস্তিনি শিশুদের শিকার নয়, বরং হুমকি হিসেবে দেখানোর কৌশল। যদি তারা শিশু না হয়, তাহলে তাদের হত্যা অপরাধ নয়, তাদের জন্য শোক প্রকাশেরও দরকার নেই।
কয়েক দশকের নিপীড়ন
এটি নতুন কিছু নয়; এই মুছে ফেলা কয়েক দশক ধরে চলছে। প্রথম ইন্তিফাদার (১৯৮৭-৯৩) সময় ফিলিস্তিনি শিশুরা পাথর হাতে রাস্তায় নেমেছিল। তখনকার ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইতজাক রবিন সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন তাদের ‘হাড় ভেঙে দিতে’। ফলাফল? সৈন্যরা শিশুদের ধরে ধরে পাথর দিয়ে হাত ভেঙে দিতো। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, বরং একটি পরিকল্পিত দমননীতি।
এই নীতি এখনো চলছে। তবে এখন লাঠির বদলে ক্ষেপণাস্ত্র ও সাদা ফসফরাস ব্যবহার করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই- ভবিষ্যৎকে পঙ্গু করা।
মুহাম্মদ আল-দুরাহ ও ফারিস ওদেহ : প্রতিরোধের প্রতীক
২০০০ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় ১২ বছর বয়সী মুহাম্মদ আল-দুরাহ তার বাবার পাশে বসে ছিল, যখন ইসরাইলি গুলিতে সে নিহত হয়। পুরো ঘটনাটি ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল।
ফারিস ওদেহ মাত্র ১৪ বছর বয়সে একটি ইসরাইলি ট্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে পাথর ছুঁড়ছিল। কয়েকদিন পর তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই দৃশ্যগুলো ফিলিস্তিনিদের স্মৃতিতে চিরকাল খোদাই হয়ে আছে। তারা নিহত হয়েছে, কিন্তু তাদের চিত্র অমর হয়ে আছে।
ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড
ফিলিস্তিনি শিশুদের লক্ষ্যবস্তু করা নতুন নয়। ১৯৪৮ সালে দেইর ইয়াসিন গণহত্যা, ১৯৭০ সালে মিসরের বাহর আল-বাকার স্কুলে বোমা হামলা, ২০০৬ সালে লেবাননের কানায় হামলা- প্রতিবারই শিশুরা প্রধান শিকার হয়েছে।
শান্তির সময়েও হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি। ২০১৫ সালে, পশ্চিমতীরে দাওয়াবশেহ পরিবারের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ১৮ মাসের শিশু আলীকে পুড়িয়ে মারা হয়। পরে ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীরা একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে সেই মৃত শিশুর ছবি ছুরিকাঘাত করে আনন্দ উদযাপন করেছিল।
শিশুদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস
শুধু হত্যা নয়, ফিলিস্তিনি শিশুদের ভবিষ্যৎও ধ্বংস করা হচ্ছে। গাজার ৮০ শতাংশ স্কুল ধ্বংস হয়ে গেছে। খেলাধুলার মাঠ ধূলিসাৎ হয়েছে, শিক্ষকদের লাশ চাপা পড়েছে ধ্বংসস্তূপে। শিশুদের স্বপ্নও ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে।
কিন্তু তারা টিকে আছে
তারপরও ফিলিস্তিনি শিশুরা থেমে নেই। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে তারা খেলে, নিজেদের মতো করে জীবন গড়ে তোলে। তারা ধুলোয় মাখা ফুটবল লাথি মারে, তাঁবুতে বসে চুল বেণী করে, এমন ঘর আঁকে যা আর নেই। তারা কাঁদলেও হাসে, অন্ধকারেও স্বপ্ন দেখে।
ইতিহাস ও প্রতিরোধ
সাবেক ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার একবার বলেছিলেন, ‘বৃদ্ধরা মারা যাবে, আর তরুণরা ভুলে যাবে।’ কিন্তু ফিলিস্তিনি তরুণরা কিছুই ভুলে যায়নি। তাদের পূর্বপুরুষরা গ্রামের নাম, বৃক্ষের গল্প, তালাবদ্ধ দরজার চাবি, মানচিত্রের রেখা রেখে গেছেন। তারা উত্তরাধিকার সূত্রে শুধু দুঃখ নয়, বরং তাদের ভূমির প্রতি ভালোবাসা ও ফিরে আসার অধিকারও পেয়েছে। এই যুদ্ধ কেবল জমির নয়। এটি স্মৃতি, পরিচয় ও ভবিষ্যৎ রক্ষার যুদ্ধ। আর এজন্য তাদের নির্মূল করতে হবে।
ইসরাইলের দৃষ্টিতে তারাই সবচেয়ে বড় হুমকি। কারণ যতক্ষণ শিশু থাকবে, গল্প চলবে। যতক্ষণ শিশু থাকবে, ফিলিস্তিন বেঁচে থাকবে।
সূত্র : মিডল ইস্ট আই