‘ইসরাইল তখনই যুদ্ধ বন্ধ করবে, যখন লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে গাজা থেকে জোরপূর্বক সরিয়ে দেয়া হবে এবং সিরিয়াকে রাষ্ট্র হিসেবে ভেঙে ফেলা হবে।’ সম্প্রতি অধিকৃত পশ্চিমতীরে এক অনুষ্ঠানে ইসরাইলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ এমন মন্তব্য করেছেন।
গাজা যুদ্ধ থামবে কবে, জানালেন ইসরাইলের অর্থমন্ত্রী
স্মোট্রিচ বলেন, ঈশ্বরের সাহায্য এবং আমাদের বীর সেনাদের সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা এই অভিযান শেষ করব তখনই, যখন সিরিয়া ধ্বংস হবে, হিজবুল্লাহ চরমভাবে পরাজিত হবে, ইরানের পারমাণবিক হুমকি দূর হবে, গাজা থেকে হামাস নির্মূল হবে এবং লাখ লাখ গাজাবাসীকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হবে।
গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ইসরাইল সরকারের অভ্যন্তরে কিভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, স্মোট্রিচের বক্তব্যে তা স্পষ্ট।
মার্কিন মধ্যস্থতায় মার্চে এক সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পর ইসরাইল গাজায় আবারো পূর্ণমাত্রায় সামরিক অভিযান শুরু করে। যুদ্ধবিরতির পর থেকে ইসরাইল গাজার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় লাগাতার হামলা চালাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজা উপত্যকাকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলে ইসরাইল ধাপে ধাপে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার পথে এগোচ্ছে।
২ মার্চ থেকে গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ইসরাইল। যুদ্ধবিরতির পর চালানো আক্রমণগুলোতে শত শত বেসামরিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইল গাজায় অভিযান শুরু করে এবং সেই সময় থেকেই ফিলিস্তিনিদের অন্য দেশে সরিয়ে নেয়ার জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে দেশটি চাপ প্রয়োগ করে আসছে।
গাজাকে খালি করে সেখানে বিলাসবহুল অবকাঠামো গড়ে তোলার পরিকল্পনা ‘গাজা রিভেরা’ নামে প্রচার করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এই ধারণা থেকেই বাস্তুচ্যুতির পরিকল্পনা গতি পায়।
যদিও ট্রাম্পের পরিকল্পনা এখন আলোচনার বাইরে, তবে ইসরাইল গাজায় আক্রমণ আরো তীব্র করেছে এবং সেখানে মানবিক বিপর্যয় চরমে পৌঁছেছে।
জাতিসঙ্ঘের মতে, গাজা এখন দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে। সাত সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে কোনো ত্রাণ বা পণ্য সেখানে প্রবেশ করতে পারেনি।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরাইলি অভিযানে এখন পর্যন্ত ৫২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
স্মোট্রিচের মন্তব্য গাজার বাইরেও বিস্তৃত। এতে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্র নতুন করে আঁকার ইঙ্গিত রয়েছে।
লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযান
হিজবুল্লাহকে মারাত্মকভাবে পরাজিত করার প্রতিশ্রুতি ইসরাইলের লেবানন আগ্রাসনের দিক নির্দেশ করে, যেখানে তারা দক্ষিণ লেবাননের পাঁচটি কৌশলগত উচ্চভূমি দখল করে আছে।
২০২৩ সালের নভেম্বরে হিজবুল্লাহ ও ইসরাইল একটি যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছালেও সেই চুক্তির শর্ত পূরণে ইসরাইলকে একতরফাভাবে ক্ষমতা দেয়া হয়। এতে হিজবুল্লাহর সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের দাবি ওঠে।
সম্প্রতি ইসরাইল দক্ষিণ বৈরুতের একটি আবাসিক এলাকায় বিমান হামলা চালায়।
লেবাননের মার্কিনপন্থী প্রেসিডেন্ট জোসেফ আউন ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করেন, যেন তারা ইসরাইলকে অবিলম্বে আগ্রাসন বন্ধ করতে বাধ্য করে। তিনি বলেন, লেবাননের সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডের ওপর ইসরাইলের চলমান হামলা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়।
তবে যুক্তরাষ্ট্র আউনের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করার জন্য—শুধু দক্ষিণ লেবাননেই নয়, বরং দেশব্যাপী।
সিরিয়াকে ধ্বংসের হুমকি
সিরিয়া প্রসঙ্গে স্মোট্রিচের মন্তব্য মার্কিন প্রশাসনের অবস্থানের সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ ট্রাম্প প্রশাসন উত্তর-পূর্ব সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহার করছে।
মার্কিন কংগ্রেসম্যান মার্লিন স্টুটজম্যান জানান, এপ্রিল মাসে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারারের সাথে বৈঠকে তিনি ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে সিরিয়া ভাঙার ইসরাইলি পরিকল্পনা নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ইসলামপন্থী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) সিরিয়ার আসাদ সরকারকে উৎখাতের পর ইসরাইল দক্ষিণ-পশ্চিম সিরিয়ার একটি অংশে সেনা মোতায়েন করে। এরপর থেকে তারা জাতিসঙ্ঘ-নির্ধারিত বাফার জোনে অবস্থান করছে এবং নিয়মিত বিমান হামলা চালাচ্ছে।
এই মাসের শুরুতে ইসরাইল সিরিয়ার তিয়াস বিমানঘাঁটি (টি৪) লক্ষ্য করে হামলা চালায়, যেখানে তুরস্ক সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনা করছিল।
মিডল ইস্ট আই জানায়, ইসরাইল উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় আরো সৈন্য রাখার জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে তদবির করলেও জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ তা প্রত্যাখ্যান করে।
ইসরাইলি কর্মকর্তারা সিরিয়ার কুর্দি ও ড্রুজ সংখ্যালঘুদের সহায়তার কথা বললেও কুর্দি নেতারা জানিয়েছেন, তারা কোনো সামরিক বা গোয়েন্দা সহায়তা পাননি।
অন্যদিকে, সিরিয়ার ড্রুজ নেতারা দক্ষিণ-পশ্চিমে ইসরাইলের আগ্রাসনের নিন্দা করেছেন।
সূত্র : মিডল ইস্ট আই