গিডিয়নের রথ, গাজা, ইসরাইল, হামাস

গিডিয়নের রথ : গাজাবাসীকে ধ্বংস ও নির্বাসনের সর্বশেষ ইসরাইলি রূপরেখা

ইসরাইলি সেনাবাহিনী গাজা উপত্যকার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে ফিলিস্তিনিদের দক্ষিণে একটি ছোট এলাকায় স্থানান্তর করতে এবং তাদের অনাহারে মৃত্যু ঠেকাতে ন্যূনতম খাদ্য সরবরাহের পরিকল্পনা করেছে, যা ‘গিডিয়নের রথ’ নামে পরিচিত একটি সম্প্রসারিত সামরিক অভিযানের অংশ।

ইসরাইলের নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা এই পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে এবং সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা গাজায় হাজারো রিজার্ভ সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে অভিযান জোরদার করছে।

ইসরাইলি গণমাধ্যম জানায়, যদি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফর শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত হামাস বন্দীদের মুক্তি নিয়ে কোনো চুক্তি না হয়, তবে ইতিমধ্যেই আংশিকভাবে বাস্তবায়িত পরিকল্পনাটি সম্পূর্ণরূপে শুরু হবে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর এক ভিডিও বার্তায় এ পরিকল্পনার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

গিডিয়নের রথ কি?

নেতানিয়াহু এক্স-এ পোস্ট করা ভিডিওতে বলেন, গাজার জনসংখ্যা স্থানান্তরিত করা হবে এবং ইসরাইলি বাহিনী ঢুকে আর ফিরে আসবে না।

তিনি বলেন, গাজায় রিজার্ভ বাহিনী প্রবেশ করবে। এলাকা দখলে রাখবে। আমরা অভিযান চালিয়ে গাজায় প্রবেশ করলে আর ফিরব না। এটাই পরিকল্পনা নয়, বরং সম্পূর্ণ উল্টোটা আমাদের উদ্দেশ্য।”

বিভিন্ন মানবাধিকার ও সহায়তা সংস্থার কঠোর সমালোচনা সত্ত্বেও নেতানিয়াহু এ পরিকল্পনাকে যুদ্ধের চূড়ান্ত ধাপ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যেখানে দুর্ভিক্ষ ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে।

যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের পর থেকে ইসরাইল গাজায় কোনো ধরনের সাহায্য প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। নেতানিয়াহুসহ ইসরাইলি কর্মকর্তারা দাবি করছেন, সামরিক চাপই গাজায় বন্দী ব্যক্তিদের মুক্ত করার একমাত্র উপায়।

ইসরাইলি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরাইলি বাহিনী গাজা পুরোপুরি দখল করে জনগণকে দক্ষিণ-পশ্চিমের মোরাগ অক্ষ ও ফিলাডেলফি করিডোরের মধ্যে একটি নতুন এলাকায় স্থানান্তর করবে।

কান ১১ চ্যানেল প্রকাশিত একটি মানচিত্র অনুযায়ী, এই নতুন এলাকা উপকূল থেকে বিচ্ছিন্ন এবং পূর্বে একটি বাফার জোন দ্বারা ঘেরা থাকবে, যা ইসরাইল গাজার সীমান্ত বরাবর নির্মাণ করেছে।

ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম ইয়োনেট জানায়, ‘গিডিয়নের রথ’ পরিকল্পনার নামকরণ করা হয়েছে প্রাচীন ইসরাইলি যোদ্ধা গিডিয়নের নামে, যিনি মিদিয়ানদের বিরুদ্ধে কয়েকশ যোদ্ধার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

পরিকল্পনাটি তিনটি ধাপে সম্পন্ন হবে : প্রস্তুতি, জনসংখ্যা একত্রিতকরণ ও স্থল কৌশল

প্রস্তুতি ধাপটি শুরু হয় কয়েক সপ্তাহ আগে, যখন ইসরাইলি বাহিনী রাফার গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস করতে শুরু করে, যার মধ্যে আবাসিক ভবনও ছিল।

এই ধাপ ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর শেষ হওয়া পর্যন্ত চলবে। এর মধ্যে রাফাহ অঞ্চলে ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘকাল রাখার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

রাফাহকে একটি জীবাণুমুক্ত অঞ্চলে রূপান্তর করা হবে, যেখানে প্রবেশের অনুমতি মিলবে কেবল নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশির পর।

আইডিএফ এবং শিন বেটের সহযোগিতায় রাফায় পৌঁছানোর প্রধান সড়কে চেকপয়েন্ট স্থাপন করে বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের ওই এলাকায় পাঠানো হবে।

ইসরাইল ঘোষিত নতুন মানবিক অঞ্চল-এ সাহায্য বিতরণের জন্য একাধিক পয়েন্ট থাকবে এবং সেখানে মার্কিন বেসরকারি নিরাপত্তা ঠিকাদাররা কাজ করবে।

এই এলাকায় ইসরাইলি বাহিনী প্রহরার দায়িত্ব পালন করবে এবং প্রতিদিন মাত্র ৬০টি খাদ্যবাহী ট্রাক প্রবেশ করতে পারবে, যা যুদ্ধবিরতির সময়ের তুলনায় এক দশমাংশ।

জনসংখ্যা একত্রিতকরণ ধাপে, ইসরাইলি বাহিনী গাজার সর্বত্র তীব্র আগুন ব্যবহার করে ফিলিস্তিনিদের তাদের বাড়ি ছেড়ে রাফায় চলে যেতে বাধ্য করবে।

এই ধাপে দুইটি লক্ষ্য থাকবে। হামাসের উপর চাপ সৃষ্টি করে যুদ্ধ থামানো এবং ফিলিস্তিনিদের মিশর, ইসরাইল সীমান্ত এবং উপকূলের দিকে ঠেলে দিয়ে তাদের স্বেচ্ছায় গাজা ছাড়তে উৎসাহিত করা।

এইভাবে ট্রাম্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা হবে, যেখানে তিনি মিশর ও জর্ডানকে ফিলিস্তিনিদের গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং গাজা পরিষ্কার করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

ইয়োনেট-এর তথ্য অনুযায়ী, পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইসরাইল কয়েকটি দেশের সঙ্গে আলোচনা করছে, যাতে তারা কিছু ফিলিস্তিনিকে গ্রহণ করে, পরে যাদের নির্বাসিত করা হবে।

ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম জানায়, এই পর্যায়ে মানবিক সাহায্য পুনরায় চালু হবে, তবে তা শুধু দক্ষিণের নতুন এলাকায় বিতরণ করা হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সহায়তা পুরোপুরি বন্ধ না হলেও এর পরিমাণ অনেক কম থাকবে, মার্চের শুরুতে আরোপিত অবরোধের আগে যতটা সহায়তা দেওয়া হতো, তার তুলনায়।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, মানবিক সহায়তা কেন্দ্রে পৌঁছানো জনগণ প্রয়োজনীয় সব চাহিদা পূরণ করবে।

ইসরাইলি আর্মি রেডিও জানায়, সপ্তাহে মাত্র একবার সাহায্য বিতরণ করা হবে এবং প্রতিটি পরিবারের একজন প্রতিনিধিকে তা গ্রহণ করতে দেওয়া হবে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিটি পরিবারের একজন প্রতিনিধিকে কেন্দ্র থেকে নির্ধারিত পরিমাণে সাহায্য নিতে দেওয়া হবে।

ইসরাইলি সেনাবাহিনীর হিসেব অনুযায়ী, একটি পরিবার গড়ে প্রতি সপ্তাহে ৭০ কেজি খাবার প্রয়োজন, তাই প্রতিটি প্রতিনিধি সেই পরিমাণ সহায়তা পাবে, যা অনাহার ঠেকাতে যথেষ্ট।

জাতিসংঘের ওচা জানিয়েছে, ছয় মাস থেকে দুই বছর বয়সী শিশুদের ৯২ শতাংশ এবং তাদের মায়েরা প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাচ্ছে না, পাশাপাশি গাজার ৬৫ শতাংশ মানুষ বিশুদ্ধ পানির অভাবে রয়েছে।

গাজা দখলের পরিকল্পনা

ইয়োনেট জানায়, অসুস্থ ও আহতদের সরিয়ে নেওয়ার পর, ইসরাইলি সেনাবাহিনী তৃতীয় ধাপ শুরু করবে, যা কয়েক মাস ধরে চলবে এবং বড় পরিসরের অভিযান চালানো হবে।

এই ধাপের লক্ষ্য গাজা দখল এবং দীর্ঘমেয়াদে সেখানে অবস্থান।

প্রতিবেদন অনুসারে, সেনাবাহিনী হামাসের জন্য উপযোগী অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দেবে এবং গেরিলা যুদ্ধের জন্য ব্যবহৃত সুড়ঙ্গ শনাক্ত ও ধ্বংস করবে।

সোমবার রাতে সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডিফ্রিন জানান, এই আক্রমণে বিস্তৃত হামলা ও জনসংখ্যা স্থানচ্যুতি অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

তিনি বলেন, এই অভিযান হামাসমুক্ত এলাকায় সুরক্ষা প্রতিষ্ঠা, বিমান হামলা বজায় রাখা, সন্ত্রাসী নির্মূল এবং অবকাঠামো ধ্বংসে সহায়ক হবে।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ বলেন, মার্চ লাইনের বাইরে পরিষ্কার করা এলাকা ইসরাইল নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করবে।

তিনি আরও বলেন, যেকোনো অস্থায়ী বা স্থায়ী ব্যবস্থায়, গাজার আশপাশের নিরাপত্তা অঞ্চল ইসরাইল ত্যাগ করবে না, যা শহরগুলোর সুরক্ষা ও অস্ত্র পাচার রোধে অপরিহার্য।

কাটজ আরও বলেন, যদি হামাসের সঙ্গে কোনো চুক্তি না হয়, তাহলে বিশেষ করে রাফাহ অঞ্চলের বাসিন্দাদের স্বেচ্ছায় অভিবাসন পরিকল্পনার অংশ করা হবে।

অতি-ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ, যিনি নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভায় রয়েছেন ও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখেন, তিনিও এই পরিকল্পনাকে সমর্থন করেন।

তিনি বলেন, আমরা যদি জয়লাভ করি, তখন গাজার উপর সার্বভৌমত্ব নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে, যদিও আমি তা যুদ্ধের লক্ষ্য হিসেবে দাবি করিনি।

তিনি আরও বলেন, একবার কৌশল শুরু হলে, দখলকৃত এলাকা থেকে ইসরাইল সরে যাবে না, এমনকি বন্দীদের বিনিময়েও নয়।

‘আমরা তাদের হারাতে পারি’ – সেনা প্রধানের সতর্কবার্তা

পরিকল্পনাটি নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন করলেও সেনাপ্রধান ইয়াল জামির সতর্ক করে বলেন, পূর্ণাঙ্গ অভিযান চালালে বন্দীদের হারানো হতে পারে।

তিনি বলেন, এই অভিযানে বন্দীদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে না, মনে রাখুন আমরা তাদের হারাতে পারি।

জামির আরও বলেন, হামাসকে পরাজিত করা ও বন্দী উদ্ধারের লক্ষ্য পরস্পরবিরোধী।

বন্দীদের পরিবারের সংগঠন হোস্টেজেস অ্যান্ড মিসিং ফ্যামিলিজ ফোরাম বহুদিন ধরে একই কথা বলছে, কিন্তু নেতানিয়াহুসহ রাজনৈতিক নেতারা মনে করেন সামরিক চাপই মুক্তির একমাত্র উপায়।

ফোরামটি জানায়, চিফ অফ স্টাফের এই সতর্কতা প্রত্যেক ইসরাইলির উদ্বেগের কারণ হওয়া উচিত।

তারা আরও বলে, জাতির বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ এই বিশ্বাসে ঐক্যবদ্ধ যে বন্দীদের ফেরত না আনলে ইসরাইল জয়ী হতে পারে না। বন্দীদের হারানো মানে ইসরাইলের পরাজয়। জাতীয় নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নির্ভর করে প্রতিটি জিম্মির প্রত্যাবর্তনের উপর।

জাতির বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বিশ্বাস করে, বন্দীদের ঘরে না ফেরানো হলে ইসরাইল বিজয়ী হতে পারে না।
বন্দীদের হারানো মানেই ইসরাইলের পরাজয়। জাতীয় নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নির্ভর করে শেষ একজন বন্দীর প্রত্যাবর্তনের ওপর।

তবুও সোমবার স্মোট্রিচ বলেন, বিজয় তখনই ঘোষণা করা হবে, যখন গাজা পুরোপুরি ধ্বংস হবে, নাগরিকরা মোরাগ অক্ষের দক্ষিণে কেন্দ্রীভূত হবে এবং অনেকে তৃতীয় দেশে অভিবাসন শুরু করবে।

অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে কাজ করা আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলি ইসরাইলের সাহায্য পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে, বলেছে এটি জীবনরক্ষাকারী পণ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েমের চেষ্টা এবং গাজার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের সাহায্য পৌঁছাতে ব্যর্থ হবে।

যৌথ বিবৃতিতে সংস্থাগুলো জানায়, জাতিসংঘ মহাসচিব ও জরুরি ত্রাণ সমন্বয়কারী স্পষ্ট করেছেন, আমরা এমন কোনো পরিকল্পনায় অংশ নেব না যা মানবতা, নিরপেক্ষতা, স্বাধীনতা ও মানবিক নীতিমালা লঙ্ঘন করে।

শুক্রবার অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গাজা অবরোধ তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে একে গণহত্যামূলক, অবৈধ যৌথ শাস্তির একটি রূপ এবং বেসামরিকদের অনাহারে রাখার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ বলে উল্লেখ করে।

এ পর্যন্ত ইসরাইলি হামলায় অন্তত ৫২,৬১৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত ও ১,১৮,৭৫২ জন আহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ।

সূত্র : মিডল ইস্ট আই

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top