মাহদি হাসান
মাওলানা আবুল হাসান আলি নদবি রাহ.ও একসময় জামায়াতে ইসলামির দায়িত্বশীল ছিলেন। মাওলানা মানজুর নুমানি রাহ.-এর মধ্যস্থতায় তাকে মাওলানা মাওদুদি রাহ. এই দায়িত্বে নিয়োজিত করেন। পরে জামায়াতে ইসলামি নিয়ে আলি মিয়া রাহিমাহুল্লাহুর ভাবনায় পরিবর্তন আসে। তিনি আত্মজীবনী কারওয়ানে জিন্দেগি-তে এ প্রসঙ্গে লিখেন,
‘প্রায় তিন বছরের কাছাকাছি সময়কাল লাখনৌ জামায়াতের দায়িত্ব ও নেতৃত্বে থাকাকালীন আমার মনে তিনটি অনুভূতি জাগ্রত হয়। এই অনুভূতিগুলো আমাকে জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা এবং এর উপকারিতা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।
এক. আমি লক্ষ্য করি যে, মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদির ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জামায়াতের সদস্যদের মাঝে অতিরঞ্জিত মনোভাব তৈরি হচ্ছিল। তারা মাওলানা মওদুদি ব্যতীত অন্য কোনো চিন্তাবিদ, লেখক বা দাঈর প্রতি উঁচু ধারণা পোষণ, তাদের উপর ভরসা রাখা বা তাদের লেখা থেকে উপকৃত হওয়ার যোগ্যতা থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিল। মনে হতো—এবং অনেক সময় তারা মুখেও বলত—মাওলানার চেয়ে উৎকৃষ্টভাবে কেউ ইসলামকে বোঝেনি বা উপস্থাপন করেনি। তিনিই দ্বীনের প্রকৃত দাঈ। এই শ্রেণির অধিকাংশই ছিল আধুনিক শিক্ষিত ও চাকরিজীবী। তাদের দীন সম্পর্কিত পড়াশোনা মাওলানা মওদুদির লেখাপত্রের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। তারা শুধু পূর্বসূরি আলেমদেই নয়, বরং সমকালীন বড় বড় উলামায়ে কেরামের দীনি খিদমত ও ধর্মীয় গবেষণা সম্পর্কেও অজ্ঞ ছিল। ইসলামের ইসলাহ ও সংস্কারের ইতিহাস এবং এর পতাকাবাহীদের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তব কীর্তি সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। (এই অনুভূতি থেকেই তিনি তার বিখ্যাত ‘তারিখে দাওয়াত ওয়া আজিমত’ সিরিজ লেখা শুরু করেন) এ কারণে একটি পর্যায় পর্যন্ত তারা মাযুরও ছিল।
দুই. মাওলানা মওদুদির মাঝে সমালোচনার মানসিকতা ক্রমশ বাড়ছিল। উলামায়ে কেরাম ও দীনি মহল সম্পর্কে তার জিহ্বা ধীরে ধীরে লাগামহীন হয়ে উঠছিল।
তিন. তার মাঝে দীনি চেতনা, আমলের উন্নতি ও আত্মশুদ্ধির কোনো দৃশ্যমান আগ্রহ বা আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কোনো সুচিন্তিত প্রচেষ্টা চোখে পড়ত না।
এই কারণে আমার মন কিছুটা অস্থির হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, এখন কাজ শুধু মাওলানার লেখা পড়া, শ্রবণ ও প্রশংসার মাঝেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে আমার নিজের অবস্থা এমন ছিল যে, মাওলানার লেখা পড়ে যতটা প্রভাবিত হতাম এবং চিন্তার জগতে যতটা আলোড়ন ও তার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতাম, সাক্ষাৎ ও দীর্ঘ সময় সঙ্গে থাকার ফলে—কোনো দৃশ্যমান কারণ বা শরঈ ভিত্তি ছাড়াই—সেই আকর্ষণ ও সম্পর্ক কমে আসছিল। সম্ভবত বংশীয় প্রভাবের কারণে আমার মন কোনো দৃশ্যমান আত্মিক ও আধ্যাত্মিক আকর্ষণ ছাড়া কোনো ব্যক্তিত্বের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হতো না।
যদিও আমি মাওলানা মওদুদির সেই কট্টর সমালোচকদের স্তরে পৌঁছাইনি, যারা তাকে কাফির বা ফাসিকের চেয়ে কম কিছু বলতে রাজি নয়। আমি এখনও তার অনেক বৈশিষ্ট্য ও চিন্তাধারার মূল্যায়ন করি। তার অনেক বিষয়কে আধুনিক শিক্ষিত যুবকদের জন্য উপকারী ও প্রয়োজনীয় মনে করি এবং সেগুলো পড়ার পরামর্শ দিই। কিন্তু মাওলানার দাওয়াত ও জামায়াতের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা ও আকর্ষণে পরিবর্তন আসছিল। এরপর মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস রহ.-এর সাক্ষাৎ, যাতায়াত এবং তার প্রভাব বাড়তে থাকে। তার দাওয়াত আমার কাছে নববি রুচি, নবিজির জীবনাদর্শ এবং দীনি দাওয়াতের প্রাণের কাছাকাছি মনে হচ্ছিল। এতে আমার মানসিক দ্বন্দ্ব আরও বেড়ে যায়। একপর্যায়ে আমি মাওলানা মওদুদিকে এ বিষয়ে জানিয়ে দিই এবং তিনি আমাকে পৃথক হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
সূত্র : কারওয়ানে জিন্দেগি
অনুবাদকের ফেসবুক থেকে গৃহীত