আবু সাঈদ
অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি নির্বাচনের ডেটলাইন ঘোষণা করেছে। এতে রাজনৈতিক মহলে একটা সাজ সাজ রব শুরু হয়েছে। সবাই দল গোছানো, প্রতিনিধি নির্বাচন, গণসংযোগসহ নানা ব্যস্ততায় সময় পার করছে। এরই মধ্যে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে যে ইসলামপন্থী দলগুলো জোটবদ্ধ হতে পারে। এ নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ ও বিচার বিশ্লেষণ চলছে- আলাদা জোট করা হবে, নাকি বড় কোনো জোটের সাথে লিয়াজোঁ করা হবে?
এ নিয়ে নানাজন নানাদিক ভাবছেন। তবে আমাদের মনে হয়, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘একতার’ তুলনায় ‘বিভক্তিই’ ইসলামপন্থীদের জন্য অধিক লাভজনক হবে। অর্থাৎ ইসলামপন্থীদের স্বতন্ত্র জোট না করে সম্ভাবনাময়ী কোনো দলের সাথে লিয়াজোঁ করাটাই স্বার্থের বিবেচনায় অধিক মুনাসিব হবে।
তবে এক্ষেত্রেও ইসলামপন্থী দলগুলোর মাঝে পারস্পরিক সমঝোতা থাকতে হবে। যেহেতু সবার টার্গেটই হলো ইসলামকে সেইফ করা এবং আল্লাহর যমিনে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করা, তাই তাদের মধ্যে সমঝোতা থাকতে হবে যে আমরা জোট না করে এই যে বিভক্তিকেই প্রাধান্য দিচ্ছি, সেটির লক্ষ্যের শেষ ধাপ হবে ইসলামকে সুরক্ষা দেয়া। তাই নিজেদের জন্য মুনাসিব জোটে অন্তর্ভুক্ত হলেও ইসলামপন্থীদের যেন জবান এক থাকে।
বিষয়টি আরেকটু খুলেই বলি। ইসলামপন্থীরা এখন জোট করে খুব বেশি লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপিই ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এখন বিরোধী দল হওয়ার অপশন থাকে ইসলামপন্থীদের সামনে। এক্ষেত্রে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আসবে এনসিপি, জাতীয় পার্টি ও আরো কিছু দল। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইটা হবে এনসিপির সাথে। এনসিপির রাজনৈতিক চরিত্র এখনো পরিষ্কার নয়। তবে তাদের এ যাবতকালের চরিত্র দেখে ধারণা হচ্ছে যে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য তারা নিষিদ্ধ দলকেও কাছে টানতে দ্বিধা করবে না। আর নির্বাচন যতই স্বচ্ছ হোক না কেন, স্থানীয় পেশী শক্তি যে তখন সক্রিয় হবে না, তার নিশ্চয়তা দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে অন্যান্য রাজনৈতিক দল পেশী শক্তি প্রদর্শন করতে পারলেও ইসলামপন্থীদের এক্ষেত্রে খুব বেশি সক্রিয় দেখা যাবে না বা তাদের পক্ষে সম্ভবও হবে না। সেজন্য বিরোধী দলীয় শক্তি হওয়াটাও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে ইসলামপন্থীদের জোট। এছাড়া ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের তৃণমূলের সাথে কিছু সম্পৃক্ততা থাকলেও অন্যান্য দলগুলোর খুব একটা নেই। এমনও দল আছে যে জেলা পর্যায়েরও তাদের স্বতন্ত্র কোনো কার্যালয় বা অফিস নেই। সেজন্য পেশীশক্তির বাইরে কেবল নিজস্ব ভোটব্যাংক দিয়েও বিরোধী দল হওয়া সহজ হবে না। যদি ইসলামপন্থী জোট বিরোধী দলীয় শক্তিও না হতে পারে, তাহলে রাজনৈতিক ভবিষ্যত সুখকর হবে না।
যদি ইসলামপন্থীদের আলাদা জোট হয়, আর রাজনীতিতে নিজেদের বোঝাপাড়া তেমন পোক্ত না হয়, তাহলে এতে ভাঙন চলমান থাকবে। কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতির প্রকৃতি হলো, শক্তিশালী দল দুর্বল দলগুলোকে বিভক্তির মধ্য দিয়ে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে। সে হিসেবে ইসলামী জোটকে শান্ত থাকতে দেবে না। এছাড়া সরকার যখন ইসলামের স্বার্থবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে, তখন এই জোট সরকারের উপর সুবিধাজনকভাবে পেশারও ক্রিয়েট করতে পারবে না। কারণ, তখন সরকার পক্ষ এটিকে ধর্মীয় দিক থেকে না দেখে রাজনৈতিক দিক থেকে দেখবে। তখন দমন-পীড়ন বা কমপক্ষে উপক্ষার নীতি অবলম্বন করবে। এতে অলাভজনক জোটের কারণে ইসলামের স্বার্থ ব্যাহত হতে পারে।
পক্ষান্তরে ইসলামপন্থীরা যদি জোট না করে বিভক্তিই ধরে রাখে, এমনিভাবে তারা নিজেদের সুবিধাজনক দলের সাথে লিয়াজোঁ করে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ শরীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, তাহলে এই হবে ইসলামপন্থীদের জন্য সর্বাপেক্ষা ভালো। কথার কথা, কোনো দল বিএনপির সাথে জোট বাঁধলো, কেউ এনসিপির সাথে লিয়াজোঁ করলো, কেউ স্বতন্ত্রই থাকলো। এভাবে ইসলামপন্থীরা যদি বিভিন্ন দলের সাথে থাকে, তাহলে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিটা সহজ হবে। সরকার যখন ইসলামের স্বার্থবিরোধী কোনো পদক্ষেপ নিতে যাবে, তখন একদিকে নিজের শরিক দল থেকে বাধার মুখে পড়বে, এরপর বিরোধী দলেরও আপত্তির মুখে পড়বে, আবার স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল থেকেও বিরোধিতা দেখবে, এভাবে নানামুখী বিরোধিতার কারণে সরকার বিষয়টি উপেক্ষা করতে পারবে না। এভাবে ইসলামের স্বার্থ রক্ষা করাটা সহজ হবে।
তবে ইসলামপন্থীদের স্বতন্ত্র দলের দিকেই মনোযোগ নিবদ্ধ রাখলে চলবে না। বরং সম্ভাবনাময়ী কিংবা বড় দলগুলোতেও নিজেদের প্রতিনিধি তৈরি করতে হবে। সেজন্য বিএনপিতেও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ইসলামপন্থী রাজনীতিবিদ থাকতে হবে। এনসিপি কিংবা অন্য দলগুলোতেও ইসলামপন্থী রাজনীতিবিদ তৈরি করতে হবে। যেন সব মহলেই ইসলামের স্বার্থ বিবেচনায় রাখার মতো লোকজন উপস্থিত থাকে।
অবশ্য মনে রাখতে হবে যে অন্যদের সাথে লিয়াজোঁ করাটা সাময়িক সমাধান মাত্র। এটি স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। স্থায়ী সমাধান সেটিই- নিজেরা নিজেদের পায়ে দাঁড়ানো। সেজন্য লিয়াজোঁতে থাকা অবস্থায় নিজেদের দলকে ভালোভাবে গুছিয়ে নিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে তৃণমূলে নিজেদের সম্পৃক্ততা ও উপস্থিতি সুদৃঢ় করতে হবে। এছাড়া লিয়াজোঁ জোটে গিয়ে এমপি প্রার্থীর পাশাপাশি স্থানীয় সরকার পর্যায়েও নিজেদের হিস্যা নিশ্চিত করে নিতে হবে। এভাবে প্রাথমিক পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত যেন উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়, সেদিকে মনোযোগ দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। এছাড়া দলের কর্মীদের যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে রাজনৈতিক বিচক্ষণতা বৃদ্ধি করতে হবে। মোটকথা পুরোদস্তুর রাজনীতিতে মনোনিবেশ করতে হবে।
আমাদের বিবেচনায়, এখন ইসলামপন্থীদের ‘বিভক্তিকেই’ প্রাধান্য দেয়া উচিৎ। তবে নিজেদের সুন্দর বোঝাপাড়া যেন অটুট থাকে, সেদিকেও মন রাখতে হবে। এই বিভক্তি যেহেতু ইসলামেরেই স্বার্থে, তাই প্রয়োজনীয় শক্তি অর্জন করার পর যেন সহজেই একত্রিত হওয়া যায়, সেদিকেও সচেতন থাকতে হবে। মোটকথা, সর্বাবস্থায় ইসলামের স্বার্থ রক্ষার জন্যই আমাদের রাজনীতি করতে হবে। আমাদের জোট হবে ইসলামের স্বার্থে। আমরা বিভক্তি ধরে রাখব ইসলামেরই স্বার্থে। তবে একদিন এদেশে কালেমার পতাকা উড়বে। ইনশাআল্লাহ।
লেখক : আলেম ও সাংবাদিক