টুডেনিউজ ডেস্ক
রবিবার ভোরে ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলা নিয়ে বিশ্বকে সম্বোধন করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ সময় তিনি ধন্যবাদ জানান মার্কিন সেনাবাহিনী, বোমা ফেলা পাইলট, এক জেনারেল এবং একজন বিদেশি নেতা—ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে, যার সঙ্গে তার সম্পর্ক নানা সময় ওঠানামা করেছে।
ট্রাম্প বলেন, নেতানিয়াহুর সঙ্গে তারা এমনভাবে কাজ করেছেন, “যেভাবে আগে কেউ করেনি।” অথচ মাত্র চার বছর আগে নেতানিয়াহু সম্পর্কে তিনি ভিন্নধর্মী, প্রায় অবমাননাকর মন্তব্য করেছিলেন। সম্প্রতি ইরানের বিরুদ্ধে উত্তেজনার সময়ও তাদের অবস্থান ছিল ভিন্ন।
ট্রাম্প কী বললেন নেতানিয়াহু সম্পর্কে?
মধ্যপ্রাচ্যে রবিবারের হামলার ঘোষণা দিতে গিয়ে ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন:
“আমি প্রধানমন্ত্রী বিবিকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাতে চাই। আমরা এমন একটি দল হিসেবে কাজ করেছি যা আগে কখনও দেখা যায়নি। ইরানের এই ভয়াবহ হুমকি মোকাবেলায় আমরা অনেকদূর এগিয়েছি।”
তিনি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকেও ধন্যবাদ জানান। পাশাপাশি ইরানকে সতর্ক করেন যে তাদের “শান্তি” গ্রহণ করতে হবে—মার্কিন শর্তে পরমাণু কর্মসূচি পরিত্যাগ করতে হবে।
“যদি তারা তা না করে, ভবিষ্যতের হামলা হবে আরও বড় ও আরও সহজ।”
উল্লেখ্য, ইসরায়েল এখনো একমাত্র মধ্যপ্রাচ্যীয় দেশ, যার কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে—যদিও তারা কখনো তা প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি।
ইসরায়েলের টানা নয় দিনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র বাঙ্কার-বিধ্বংসী বোমা দিয়ে ইরানের গোপন পারমাণবিক স্থাপনাগুলিতে হামলা চালায়। ফোর্ডো, নাতানজ ও ইসফাহানে এই হামলা হয়।
এই পদক্ষেপ মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ (MAGA) সমর্থকদের মধ্যে।
নেতানিয়াহু কী বললেন ট্রাম্প সম্পর্কে?
ট্রাম্পের ঘোষণার পর নেতানিয়াহু আরও প্রশংসাসূচক ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানান।
“প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, আপনার সাহসী সিদ্ধান্ত ইতিহাস পাল্টে দেবে,” বলেন নেতানিয়াহু একটি রেকর্ড করা ভিডিও বার্তায়।
তিনি বলেন, “ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর বিরুদ্ধে আজকের পদক্ষেপে আমেরিকা এমন কিছু করেছে, যা পৃথিবীর আর কোনো দেশ করতে পারেনি।”
তিনি আরও বলেন, “ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক শাসনব্যবস্থাকে সবচেয়ে বিপজ্জনক অস্ত্র থেকে বঞ্চিত করার কাজ করেছেন।”
যদিও আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মনে করে, ইরান বর্তমানে পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে না, তবে ট্রাম্প তা অস্বীকার করেছেন।
নেতানিয়াহু বলেন, “ট্রাম্প আজ ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন। তার নেতৃত্ব মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিতে পারে।”
তিনি উপসংহারে বলেন, “ট্রাম্প ও আমি প্রায়ই বলি: ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’—প্রথমে শক্তি, তারপর শান্তি। আজ রাতে ট্রাম্প সেই শক্তিই প্রদর্শন করেছেন।”
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তাদের সম্পর্ক কেমন ছিল?
২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।
ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং দূতাবাস তেল আবিব থেকে সেখানে স্থানান্তর করেন—নেতানিয়াহুর জন্য এটি ছিল এক ঐতিহাসিক বিজয়।
তিনি ইসরায়েলি বসতি স্থাপন সমর্থক ডেভিড ফ্রিডম্যানকে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেন।
২০১৯ সালে ট্রাম্প অধিকৃত গোলান হাইটসকে ইসরায়েলের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেন, যা আন্তর্জাতিকভাবে সিরিয়ার অংশ হিসেবে গণ্য।
২০২০ সালে তার উদ্যোগেই আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েল চারটি আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে।
২০১৮ সালে তিনি ইরান পারমাণবিক চুক্তি (JCPOA) থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেন এবং ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করেন।
এই ঘটনাগুলো নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক অবস্থানকে দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্তিশালী করে তোলে।
ট্রাম্প কেন নেতানিয়াহুর ওপর বিরক্ত হয়েছিলেন?
২০১৬ সালের জানুয়ারিতে যখন ওবামা প্রশাসন ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণে জেসিপিওএ (JCPOA) চুক্তি বাস্তবায়ন করেছিল, ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে সেটি থেকে সরে যান। তিনি চুক্তিটিকে “মূলত ত্রুটিপূর্ণ” বলে অভিহিত করেন—কারণ, তার মতে, এটি ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ও আঞ্চলিক কার্যকলাপ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে।
তবে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে Axios-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প প্রকাশ করেন, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে ২০২০ সালের মার্কিন নির্বাচনের পর। কারণ, নেতানিয়াহু পরাজিত ট্রাম্পের বদলে বিজয়ী জো বাইডেনকে দ্রুত অভিনন্দন জানান।
“যে ব্যক্তি বাইডেনকে অভিনন্দন জানানোর ক্ষেত্রে প্রথম ছিলেন, তিনি ছিলেন বিবি নেতানিয়াহু—যার জন্য আমি অন্য যে কারও চেয়ে বেশি করেছি। তিনি চুপ থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি ভুল করলেন,” বলেন ট্রাম্প।
তিনি আরও বলেন, “তিনি শুধু অভিনন্দনই জানাননি, বরং ভিডিও টেপে তা করেছিলেন। ফা\ হিম।”\\
তারপর থেকে তাদের সম্পর্ক কেমন ছিল?
প্রথমে ট্রাম্পের দল গাজায় যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতার দাবি করলেও, শিগগিরই তারা ইসরায়েলের সামরিক অভিযানকেই সমর্থন জানায়।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বিতর্কিতভাবে প্রস্তাব করেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গাজা দখল করে পুনর্গঠন করতে পারে এবং ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তর করতে পারে।” নেতানিয়াহু এই প্রস্তাবকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেন এবং বলেন, তিনি “একটি ভিন্ন গাজা তৈরির জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পরিকল্পনার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
সে মাসেই যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের কাছে ২.৫ বিলিয়ন ডলারের বোমা ও ড্রোন বিক্রির অনুমোদন দেয়।
ইরান ইস্যুতে মতপার্থক্য
ইরানের ক্ষেত্রে ট্রাম্প ধীরে ধীরে নেতানিয়াহু থেকে ভিন্ন কূটনৈতিক অবস্থান নিতে শুরু করেন।
১২ এপ্রিল–১৩ জুন ২০২৫: ওমানের মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে গোপন পারমাণবিক আলোচনা হয়।
মে মাসে, উপসাগরীয় সফরের সময় ট্রাম্প বলেন, তারা “একটি নতুন চুক্তির খুব কাছাকাছি” পৌঁছেছেন এবং নেতানিয়াহুকে অনুরোধ করেন যেন তিনি ইরানে হামলা স্থগিত রাখেন।
তিনি সাংবাদিকদের জানান, “এখনই হামলা অনুপযুক্ত হবে, কারণ আমরা একটি সমাধানের দ্বারপ্রান্তে।”
১১-১২ জুন: আইএইএ জানায়, ইরান পর্যাপ্ত স্বচ্ছতা দেখায়নি এবং জাতিসংঘ চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
হামলা ও উত্তেজনার বিস্ফোরণ
১৩ জুন: ইসরায়েল ফোর্ডো, নাতানজ ও ইসফাহানে ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। এতে বহু পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও সামরিক কর্মকর্তা নিহত হন।
যুক্তরাষ্ট্র প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় জানায়, তারা এই হামলায় জড়িত নয়, এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও একে “একতরফা” পদক্ষেপ বলেন।
পারমাণবিক আলোচনাও স্থগিত হয়। ট্রাম্প স্বীকার করেন, তিনি হামলার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতেন।
১৯ জুন: আলোচনার অচলাবস্থা ও ইসরায়েলি হামলার প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প আবারও নেতানিয়াহুর পাশে দাঁড়ান, কিন্তু ইরানের সঙ্গে আলোচনার দরজা খোলা রাখেন।
২০ জুন: ট্রাম্প ইরানকে পারমাণবিক আলোচনার জন্য দুই সপ্তাহের আল্টিমেটাম দেন।
২১ জুন: তিনি ইসরায়েলের সাথে সমন্বয় করে ফোর্ডো, নাতানজ ও ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার নির্দেশ দেন এবং বলেন, “আমরা সেগুলো সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করেছি।”
সূত্র: আল জাজিরা