নেতানিয়াহু, ট্রাম্প, হোয়াইট হাউস, গাজা যুদ্ধবিরতি, মধ্যপ্রাচ্য

ট্রাম্প কেন ঘন ঘন নেতানিয়াহুকে হোয়াইট হাউসে ডাকছেন?

ট্রাম্প কেন আবার নেতানিয়াহুকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানালেন?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ছয় মাসের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এই ঘন ঘন বৈঠক একটি অস্বাভাবিক ঘনিষ্ঠতা এবং পারস্পরিক নির্ভরতার ইঙ্গিত দিলেও বাস্তবে নীতিগত সমন্বয় এবং ভিন্নমতও এই সম্পর্কে রয়ে গেছে।

বিশ্ব নেতাদের মধ্যে নেতানিয়াহু সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি, যিনি এত ঘন ঘন ট্রাম্পের আতিথ্য পেয়েছেন। যদিও ট্রাম্প ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির প্রবক্তা। তবে ইসরাইলকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে তিনি এই অঞ্চলে মার্কিন উপস্থিতিকে শক্তিশালী রাখার চেষ্টা করছেন।

তবুও নেতানিয়াহুর প্রতি ট্রাম্পের মনোভাব সবসময় ইতিবাচক ছিল না। বিশেষ করে যখন ট্রাম্প জুন মাসে ইসরাইল ও ইরানকে ১২ দিনের যুদ্ধের পর যুদ্ধবিরতিতে আনেন, তখন তিনি প্রকাশ্যে ইসরাইলকে আক্রমণ বন্ধ করতে বলেছিলেন। এমনকি তিনি বলেছিলেন, ‘তারা কী করছে তা জানে না।’

মধ্যপ্রাচ্য নীতি বিশ্লেষক অ্যারন ডেভিড মিলারের মতে, যদিও ট্রাম্প অস্থির কূটনৈতিক কৌশল অনুসরণ করেন, তবুও তিনি নেতানিয়াহুকে এমন কিছু করতে দিয়েছেন, যা অতীতে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট করেননি। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর বিরুদ্ধে সম্ভাব্য মার্কিন হামলার অনুমতি এর একটি দৃষ্টান্ত।

ট্রাম্প প্রশাসন একইসাথে হামাস, হাউছি ও ইরানের সাথে সরাসরি কূটনৈতিক আলোচনায় যুক্ত থেকেছে। এর মাঝেও ইসরাইলকে পাশ কাটিয়ে চলা হয়নি। বরং বিপরীতভাবে তার সাথে ঘনিষ্ঠ সংযোগ বজায় রাখা হয়েছে।

তবে মে মাসে ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরে ইসরাইল অন্তর্ভুক্ত না হওয়া ছিল একটি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ।

মিলার বলেন, ট্রাম্প দু’টি প্রচলিত মার্কিন-ইসরাইল কূটনৈতিক নীতির একটি ভেঙে ফেলেছেন। ‘দিনের আলো নেই’ এবং ‘সবকিছুতে সমন্বয়’-এর পরিবর্তে ইসরাইলের উপর ‘টেকসই ও গুরুতর চাপ’ প্রয়োগের দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন।

২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ট্রাম্প ক্ষমতা নেয়ার আগে তিনি নেতানিয়াহুকে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে চাপ দেন। যার ফলে আরব আমেরিকান ও যুদ্ধবিরোধী রক্ষণশীলদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।

নেতানিয়াহু প্রথমে এই চাপ মেনে নিলেও মার্চের শুরুতেই গাজায় বিমান হামলা শুরু করে ইসরাইল। এরপর থেকে গড়ে প্রতিদিন শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হচ্ছে। এদিকে, সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেনে ইসরাইলি হামলাও অব্যাহত রয়েছে।

গাজা যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা ও নেতানিয়াহুর সফরের তাৎপর্য
ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন, ‘আগামী সপ্তাহে একটি চুক্তি’ হতে পারে। যদিও এটি নিশ্চিত নয়, তারপরও নেতানিয়াহুর আগমনের পরিপ্রেক্ষিতে হোয়াইট হাউস থেকে একটি যৌথ ঘোষণা আসার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা চলছে।

মিডল ইস্ট কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের ফেলো ওমর রহমান বলেন, হামাস চুক্তির আরেক পক্ষ হওয়ায় এটি শুধুই ঘোষণা দিয়ে কার্যকর করা যাবে না।

ট্রাম্প জানিয়েছেন, কাতার ও মিসর যুদ্ধবিরতিতে সহায়তার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে এবং একটি ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব প্রস্তুত করা হয়েছে।

ইসরাইলি মিডিয়া সূত্রে জানা গেছে, ইসরাইল ট্রাম্প থেকে লিখিত প্রতিশ্রুতি চাইছে যে যদি তাদের মূল দাবি পূরণ না হয়, তবে তারা গাজায় আবার সামরিক অভিযান শুরু করতে পারবে।

এই প্রতিশ্রুতি একটি পার্শ্ব চিঠির মাধ্যমে দেয়া হতে পারে বলে জানানো হয়েছে, যাতে নিরস্ত্রীকরণ ও হামাস নেতাদের নির্বাসনসংক্রান্ত শর্ত উল্লেখ থাকবে এবং এসব বিষয়ে ইসরাইলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

সঙ্ঘাত-পরবর্তী প্রশ্ন ও মূল অমীমাংসিত ইস্যুগুলো

মিলারের মতে, এখনো যেসব বিষয় চূড়ান্ত হয়নি, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তির সংখ্যা এবং গাজায় মানবিক সাহায্যের স্থায়ী প্রবাহ।

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, হামাস কি এমন কোনো নিশ্চয়তা পাবে যে যুদ্ধ শেষ হলে ইসরাইল গাজা থেকে সরে যাবে? বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসরাইল গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত এলাকাগুলোর দখল বজায় রাখতে আগ্রহী।

নেতানিয়াহু ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ বলতে বোঝান হামাস নেতাদের বহিষ্কার ও সংগঠনটির নিরস্ত্রীকরণ। কিন্তু হামাস জানিয়ে দিয়েছে, ইসরাইলি দখল অব্যাহত থাকলে নিরস্ত্রীকরণ সম্ভব নয়।

সৌদি আরব, স্বাভাবিকীকরণ ও নতুন মোড়

নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের নজর এখনো সৌদি আরবকে আব্রাহাম চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করার দিকে। কিন্তু ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস অনুযায়ী, সৌদি আরব এই ধারণায় অনাগ্রহী। ইরানে ইসরাইলের আক্রমণ এবং এই অঞ্চলে তার হস্তক্ষেপকে কেন্দ্র করে তারা বেঁকে বসেছে।

এদিকে সিরিয়ার পুনর্গঠনের জন্য নতুন কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং উত্তেজনা হ্রাসের চেষ্টা চলছে। মিলার বলেন, ইসরাইল-সিরিয়া সম্পর্কেও কিছু যোগাযোগের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।

তবে ওমর রহমান এই মুহূর্তে স্বাভাবিকীকরণ সম্ভাবনা নাকচ করেছেন। তার মতে, সৌদি আরব ইসরাইলের সাথে বরং এক ধরনের সামরিক ভারসাম্য বা নিরাপত্তা অবরোধ পরিস্থিতি বজায় রাখতে চাইবে। ৭ অক্টোবর ২০২৩-এর হামাসের আক্রমণের আগে যে স্বাভাবিকীকরণ আলোচনা চলছিল, সেটিকে রহমান বরাবরই ‘অবাস্তব’ বলে মনে করতেন।

নেতানিয়াহুর ওয়াশিংটন সফরের সময় কোনো যুদ্ধবিরতি চূড়ান্ত হবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। তবে এটুকু নিশ্চিত যে এই বৈঠক শুধুই সৌজন্য সাক্ষাৎ নয়। বরং মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে আমেরিকার ভূমিকা এবং ট্রাম্প প্রশাসনের পরবর্তী কূটনৈতিক পন্থা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

তবুও মিলারের ভাষায়, ‘হোয়াইট হাউসের ছবি কারো মন পরিবর্তন করবে না।’ সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলে নেতানিয়াহুর জন্য এর রাজনৈতিক মূল্যও হতে পারে অপূরণীয়।

সূত্র : মিডল ইস্ট আই

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top