ইরান, যুক্তরাষ্ট্র

ট্রাম্প কেন ইরানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছেন

সাঈদ আস-সুন্নি

বর্তমানে ইরান এমন এক অভূতপূর্ব কোণঠাসা অবস্থার মধ্যে রয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে ঘিরে একদিকে কড়া হুমকি দিচ্ছে, অন্যদিকে নতুন একটি পারমাণবিক চুক্তির আলোচনার ডাক দিচ্ছে। এই চুক্তির লক্ষ্য—ইরানকে স্থায়ীভাবে পারমাণবিক অস্ত্র থেকে বিরত রাখা, এমনকি শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করা।

তবে এই আহ্বান যতটা না আলোচনার, তার চেয়ে বেশি হুমকিস্বরূপ। এর আগেই উত্তর ইয়েমেনে হুথি আনসার আল্লাহ গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রিত এলাকায় মার্কিন হামলা বেড়ে যায়। একই সঙ্গে ভারত মহাসাগরের দিয়েগো গার্সিয়া ঘাঁটিতে মোতায়েন করা হয় ছয়টি বি-২ বোমারু বিমান, যা ইরান থেকে ২,৪০০ মাইল দূরে।

এইসব পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য স্পষ্ট: ইরানি শাসকদের ওপর চাপ তৈরি করা, যাতে ভবিষ্যতের নেতৃত্ব আরও নমনীয় হয় এবং মার্কিন স্বার্থের প্রতি অনুগত থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত কৌশলই হচ্ছে—প্রথমে শক্তির হুমকি, এরপর শক্তি প্রদর্শন, এবং শেষে প্রয়োজনে তা প্রয়োগ। এই বাস্তবতা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি সিরিয়া ও লেবাননে ইসরায়েলি আগ্রাসনের মাধ্যমে। গাজায় পুনরায় সংঘাত শুরু হয়েছে, যুদ্ধবিরতির চুক্তিগুলো ভেঙে গেছে, যদিও এসব চুক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল আমেরিকাই। এমন প্রেক্ষাপটে আলোচনার সম্ভাবনার চেয়ে আত্মসমর্পণের আহ্বানই বেশি প্রতীয়মান হচ্ছে।

তবে ইরানও নীরব নয়। দেশটি পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে—তারা পূর্বে পারমাণবিক বোমা চায়নি, কিন্তু হামলা হলে তা তৈরি করতে দ্বিধা করবে না। তারা দিয়েগো গার্সিয়া ঘাঁটি ও মধ্যপ্রাচ্যের দশটি মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার হুমকি দিয়েছে, যেখানে ৫০,০০০ মার্কিন সেনা অবস্থান করছে। একই সঙ্গে তারা জানিয়েছে, পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে পরোক্ষ আলোচনায় তাদের আপত্তি নেই।

এই হুমকির পেছনে থাকা রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্য খুবই পরিষ্কার। প্রথমত, ইরানের পারমাণবিক ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র (ব্যালিস্টিক ও হাইপারসনিক) উৎপাদন বন্ধ করা। দ্বিতীয়ত, ইসলামী শাসনব্যবস্থার পতন ঘটানো, যা এই অঞ্চলের প্রতিরোধ অক্ষের মেরুদণ্ড। তৃতীয়ত, ইরানকে দুর্বল করে প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর প্রতি তার সমর্থন ছিন্ন করা, বিশেষ করে লেবানন, ফিলিস্তিন, ইরাক ও ইয়েমেনে। এই পথ ধরে শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনি প্রশ্নকে “মুছে” ফেলা এবং ইরানকে ইসরায়েলের হুমকি হিসেবে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা।

ইরান আজ যে অবস্থানে এসেছে, তার পেছনে রয়েছে ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লব। আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে দেশটি শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে উৎখাত করে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটায়। এরপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে দ্বন্দ্ব ক্রমেই তীব্র হয়েছে।

এই বৈরিতা আরও বেড়েছে ইরানের গঠিত প্রতিরোধ অক্ষের কারণে। এটি একটি ভূরাজনৈতিক বলয়, যা ইসরায়েলকে ঘিরে রেখেছে এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলেছে। এই অক্ষের প্রভাবেই হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়ে পড়েছে, লেবাননের রাজনীতিতে তাদের প্রভাব হ্রাস পেয়েছে। সাম্প্রতিক লেবানন যুদ্ধ তাদের নেতৃত্ব ও সামরিক ক্ষমতাকে ভেঙে দেয়। এতে হিজবুল্লাহ মহাসচিব হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হন (২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪)।

একই সঙ্গে ইয়েমেনে হুথিরাও মার্কিন হামলার লক্ষ্যবস্তু। এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের কৌশল হতে পারে—প্রতিরোধ অক্ষের অংশীদারদের একে একে দুর্বল করে, শেষে ইরানকে একা ফেলে দেওয়া। এই প্রক্রিয়ায় সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন ঘটানো এবং হিজবুল্লাহর সরবরাহ লাইন কেটে দেওয়ার চেষ্টাও অব্যাহত।

গাজায় যুদ্ধ ও অপারেশন প্রোটেক্টিভ এজ-এর পর ইরান “কৌশলগত ধৈর্য” দেখিয়েছে। কিন্তু এই ধৈর্য অনেক সময় দ্বিধা ও স্থবিরতায় রূপ নিয়েছে। ইরান হিজবুল্লাহকে গাজার সহায়তায় পাঠালেও তাদের “যুদ্ধের নিয়ম” মানতে বাধ্য করেছে। ফলে ইসরায়েল ফুয়াদ শুকর (৩০ জুলাই, ২০২৪) ও সালেহ আল-আরৌরি (২ জুলাই, ২০২৪)-এর মতো নেতাদের হত্যা করেছে বৈরুতের উপকণ্ঠে, অথচ প্রতিরোধ পক্ষ কোনও জবাব দিতে পারেনি।

এই পরিস্থিতি হিজবুল্লাহর “ইচ্ছাশক্তির” দুর্বলতা, এবং আরও স্পষ্টভাবে ইরান নেতৃত্বের অনিচ্ছা ও ব্যর্থতাকে সামনে এনেছে। ইসরায়েল এই সুযোগে একাধিকবার হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতাদের হত্যা করেছে।

সবশেষে, কাসেম সোলাইমানিকে মার্কিন ড্রোন হামলায় হত্যা (৩ জানুয়ারি, ২০২০) এবং দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলি হামলার (১ এপ্রিল, ২০২৪) জবাবে ইরান কার্যকর প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেনি। এর ফলেই ইসরায়েল সাহস করে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতির অভিষেকে অংশ নিতে আসা ইসমাইল হানিয়াকে তেহরানে হত্যা করে (৩১ জুলাই, ২০২৪)।

ইরান দুর্বল নয়। তবে এই মুহূর্তে দেশটি নিজ নীতির মূল্য দিচ্ছে। কৌশলগত ধৈর্য কেবল তখনই কার্যকর, যখন তা যথাসময়ে ও যথোপযুক্ত মাত্রায় শক্তি প্রয়োগের সঙ্গে যুক্ত থাকে। শুধু শক্তি থাকলেই যথেষ্ট নয়—তা প্রয়োগ করার ইচ্ছা এবং সঠিক সময়ে ব্যবহারের সাহসও থাকা চাই।

এই জটিল ও সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে আমাদের প্রার্থনা—ঈশ্বর যেন এই অঞ্চলের ওপর থেকে অন্ধকারের ছায়া সরিয়ে নেন। কারণ বর্তমানে যা ঘটছে, তা শুধু একটি দেশের নয়, পুরো অঞ্চলের জন্য ব্যাপক বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

সূত্র : আল জাজিরা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top